শহরের মানুষদের মেকি মেকি লাগে : সালাউদ্দিন লাভলু
অনেকদিন হলো ঢাকার অদূরে পূবাইলে তাঁর বসবাস। ধুলোবালুর যান্ত্রিক শহর ছেড়ে প্রাণের তাগিদেই থাকছেন সেখানে। তাই কাজটাও চলছে পুরোদমে। কথা হচ্ছিল বরেণ্য নির্মাতা সালাউদ্দিন লাভলুকে নিয়ে। নতুন ধারাবাহিক নাটক ‘দি ভিলেজ ইঞ্জিনিয়ার’-এর কাজ শুরু করেছেন কদিন আগে। কেন শহর ছেড়ে এমন নির্জনে নিবাস? পুবাইলের ‘শান্ত পল্লী শুটিং স্পটে’ কেবল নাটক নিয়ে নয়, আরো অনেক বলা না-বলা বিষয়ে কথা বললেন এনটিভি অনলাইনের সাথে।
প্রশ্ন : আপনার নাটকের নাম সব সময় বাংলা হয়। হঠাৎ করে তাহলে ‘দি ভিলেজ ইঞ্জিনিয়ার’ নামকরণ কেন?
উত্তর : আপনি দেখেন, নাটকের মধ্যেই ভিলেজ বিষয়টা জড়িয়ে আছে। আর নাটকটি কমেডি। দর্শককে আনন্দ দেওয়ার জন্য নাটকটা জুতসই। তাই এমন নাম রাখা। মাসুম রেজা নাটকটির চিত্রনাট্য লিখেছেন। আমি যে এখন নাটকগুলো বানাচ্ছি সেখানে আসলে নায়ক-নায়িকা বলে কিছু নেই। সবগুলো চরিত্রই প্রধান। ঠিক এ রকমই একটি চরিত্র ‘দি ভিলেজ ইঞ্জিনিয়ার’। এই চরিত্রে অভিনয় করছেন মোশাররফ করিম। খুব মজার একটা ক্যারেক্টার। মোশাররফ করিম অনেক ভালো অভিনয় করছেন।
প্রশ্ন : আপনি সব সময় শিল্পীদের খুব গুছিয়ে শট বুঝিয়ে দেন। শট ওকে না হলে কি শিল্পীদের ওপর রাগ করেন?
উত্তর : আমি কখনোই এমন করি না। আমি নিজেই একসময় অভিনয় করেছি। আমার মনে হয় শিল্পীদের সঙ্গে সব সময় শিল্পীসুলভ আচরণ করা প্রয়োজন। কারণ তাদের সঙ্গে রাগারাগি করলে তারা ঠিকঠাক পারফরম্যান্স করতে পারবে না। যতক্ষণ তাদের মন ভালো থাকবে, ঠিক ততক্ষণই তারা সেরা পারফরম্যান্স দিতে পারবে।
প্রশ্ন : এমনিতে কি কারো সাথে রাগারাগি হয় না?
উত্তর : না। সত্যি আমি কখনো কারো সঙ্গে রাগ করি না। কেউ যদি আমার সঙ্গে রাগও করে, আমি চুপচাপ বসে থাকি। রাগ বিষয়টাই আমার পছন্দ না।
প্রশ্ন : আপনাকে যদি আলিশান বাড়িতে শহুরে ঘরানার নাটক বানাতে বলা হয়...
উত্তর : এটা আমাকে দিয়ে হবে না। শহর আমাকে টানে না। শহরের মানুষদের মেকি মেকি লাগে। শহরের মানুষদের সম্পর্ক, আদান-প্রদান সব কৃত্রিম মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, তারা বুঝি একে অন্যকে ভালোবাসেও স্বার্থের জন্য। তাদের হাসিও আমার কাছে নকল লাগে। শিল্প নির্মাণ কিন্তু বিশ্বাস ছাড়া হয় না।
প্রশ্ন : গ্রামকে বেছে নেওয়া কি সে জন্যই?
উত্তর : বলতে পারেন। আমাকে গ্রামীণ সমাজ অনেক টানে। আমরা শহরে বাস করলেও মোটামুটি অনেকেরই শৈশব, কৈশোর গ্রামে কেটেছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ মধ্যবিত্ত। খুব কম মানুষই আপার ক্লাসের। এই জীবন আমার বোঝা সম্ভব নয়, হয়তো কাছাকাছি যেতে পারি।
প্রশ্ন : গ্রামে আপনি কতদিন থেকেছেন?
উত্তর : বেশিদিন থাকা হয়নি, এই বছর পাঁচেক। আমাদের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। বেশি খেকেছি যশোরে। ছোটবেলায় দাদাবাড়ি, নানাবাড়িতে যাওয়া পড়ত। ছোটবেলা থেকেই গ্রাম আমাকে অন্যরকম টানে।
প্রশ্ন : আপনি দীর্ঘদিন মঞ্চ করেছেন। শিল্পচর্চায় আপনার মতাদর্শ কী?
উত্তর : শিল্প কিন্তু মানুষকে শুধু বিনোদন দেওয়ার জন্য নয়। নাটক দেখিয়ে মানুষকে স্বপ্ন দেখানো যায়, সমাজ বদলানো যায়। আমার মতাদর্শ হলো শিল্প শ্রেণিবৈষম্য হটিয়ে দেয়। মনে রাখতে হবে যে আমাদের দেশে ৬৫ ভাগ লোক এখনো গ্রামে বসবাস করে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখন হিন্দি সিরিয়াল দেখে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
উত্তর : হ্যাঁ। আমি বিশ্বাস করি আমাদের নাটক কেউ আর দেখছে না।
প্রশ্ন : এ রকম হওয়ার কারণটা কী?
উত্তর : বাংলাদেশে এখন ২৫-২৬টার মতো চ্যানেল। প্রতিদিন যদি চারটা নাটকও বানানো হয়, তাহলে দিনে ১০০টা নাটক প্রচার হয়। এই ভালো নাটক নির্মাণ করার জন্য ৫০০ জন লেখক, ৫০০ জন পরিচালক, ৫০০ জন ভালো অভিনেতা এখনো বাংলাদেশে নেই। চ্যানেলের চাহিদা কোনোভাবেই আমরা মেটাতে পারছি না। আমরা যখন রঙের মানুষ, ভবের হাট বানিয়েছি- ফারুকী যখন সিরিয়ালগুলো বানিয়েছে, তখনো কিন্তু হিন্দি সিরিয়াল ছিল। সবাই ওসব সিরিয়াল বাদ দিয়ে আমাদের নাটক দেখা শুরু করেছিল। মাঝখানে আমরা যখন দিনে ১০০টা নাটক বানাতে শুরু করলাম, তখনই নাটকের মান খারাপ হতে শুরু করল। দর্শক তো স্বাধীন। আপনি তো তাকে জোর করে পর্দার সামনে ধরে রাখতে পারবেন না। দর্শককে তৃপ্তি দেওয়ার জন্য যে নাটক বানানোর দরকার সেটা আমরা পারছি না। এ ছাড়া চ্যানেলের নাটক প্রচারের যে নীতিমালা! যেমন এক মিনিট নাটক দেখিয়ে সাত মিনিটের বিজ্ঞাপন। এটা দেখেও সবাই অনেক বিরক্ত হয়।
প্রশ্ন : কীভাবে ভালো নাটক নির্মাণ করা সম্ভব?
উত্তর : আমি একা বললে হবে না। সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রযোজককে ভাবতে হবে, চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে শুধু ভালো নাটক প্রচার করতে হবে, শিল্পীদের কাজটি শিখে আসতে হবে, পরিচালকদেরও ভাবতে হবে তাদের নাটক কেউ না দেখলে কেন তারা মার্কেটে থাকবে। সবাইকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে। মোশাররফ, চঞ্চল, হাসান এদের প্রত্যেকেরই অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে। তাঁদের অভিনয় দক্ষতা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রশ্ন : শুনলাম আপনি পুবাইলেই এখন খাকছেন?
উত্তর : ঠিকই শুনেছেন। কয়েক বছর ধরে আমি এখানেই আছি। ঢাকায় শুধু কাজের জন্য আসা-যাওয়া করি।