বিষণ্ণতার কারণ ও চিকিৎসা
বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন বর্তমানে একটি প্রচলিত মানসিক সমস্যা। কারো মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্ণতা চলতে থাকলে এটি পরবর্তীকালে জটিল মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই কারো মধ্যে বিষণ্ণতার লক্ষণ প্রকাশ পেলে কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা জরুরি।
মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রে কোনো একটি মাত্র কারণ দায়ী থাকে না; বরং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ জন্য জেনেটিক বা বংশগতির প্রভাব বা বায়োলজিক্যাল বা জীববিদ্যার প্রভাব এবং মনোদৈহিক প্রভাব ও জীবনব্যাপী বিভিন্ন মাত্রার মানসিক চাপের ফলে বিষণ্ণতা সৃষ্টি হতে পারে। মস্তিষ্কের জৈব রাসায়নিক সমস্যার বহুমাত্রিক প্রভাবে বিষণ্ণতা হতে পারে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। আবার মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট রাসায়নিক অবকাঠামো নিউরোট্রান্সমিটারের নানাবিধ সমস্যার জন্য বিষণ্ণতা-সংক্রান্ত মানসিক অসুস্থতা সৃষ্টি হতে দেখা যায়।
তবে এগুলো ছাড়াও নানাবিধ পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত দুরবস্থা ব্যক্তির জীবনে ডিপ্রেশনের অবস্থা সৃষ্টি করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পারিবারিক কলহ ও মা-বাবার দাম্পত্য অশান্তি পরিবারের অন্য সদস্যদের মনোবৈকল্যের সৃষ্টি করতে পারে এবং এ জাতীয় মানসিক সমস্যার ভেতরে বিষণ্ণতার অবস্থান থাকে এক নম্বরে।
বিষণ্ণতার চিকিৎসাপদ্ধতি
রোগনির্ণয়
বিষণ্ণতার চিকিৎসাপদ্ধতি জটিল এবং এ রকম ধারণা অনেকে পোষণ করে থাকেন। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ডিপ্রেশনের চিকিৎসা মোটেই জটিল নয়, বরং কিছুটা সময়সাপেক্ষ। প্রথম ধাপের চিকিৎসা রোগনির্ণয় করা, যাকে আমরা সহজভাবে ডায়াগনসিস হিসেবে জেনে থাকি। চিকিৎসকরা রোগীর রোগ নিরূপণে রোগনির্ণয়ে সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এর কারণ সঠিকভাবে রোগ নির্ণিত না হলে চিকিৎসার ফল সন্তোষজনক নাও হতে পারে।
রোগনির্ণয়ের তিনটি ধাপ রয়েছে :
১. চিহ্ন ও উপসর্গগুলোকে জরিপ করা।
২. রোগীর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে মস্তিষ্ক-সংক্রান্ত অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি অথচ ফলপ্রসূ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে পারে।
৩. পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় মানসিক ইতিহাস ও পারিবারিক মানসিক রোগের ইতিহাস জানা এ ক্ষেত্রে জরুরি।
শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলাকালে কিছু ল্যাবরেটরি টেস্টও করানোর প্রয়োজন হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ডিপ্রেশনের কারণ হিসেবে রোগনির্ণয়ের সময় শারীরিক নানা সমস্যা ধরা পড়ে। যেমন : অ্যানিমিয়া, থাইরয়েড অসুখ ও ভাইরাল ইনফেকশন ইত্যাদি এবং এগুলোর প্রভাবে বিষণ্ণতা হতে পারে। কাজেই শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিষণ্ণতার চিকিৎসার জন্য খুব বেশি প্রয়োজনীয়। রোগনির্ণয়ের পরবর্তী ধাপগুলো রোগী কোন ধরনের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত তার সহজ শ্রেণিবিন্যাস এবং চিকিৎসার মাত্রা ঠিক করা। যদি বহির্বিভাগের রোগী হয়ে থাকে, তবে চিকিৎসকরা যেভাবে চিকিৎসা করেন, আন্তবিভাগের রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা তার চেয়ে বেশি চিকিৎসাপদ্ধতির প্রয়োগ করে থাকেন। আবার ব্যক্তিগত চেম্বারে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও তা কিন্তু রোগীর পক্ষে যথেষ্ট উপকারী। এতে রোগী অনেক বেশি সময় চিকিৎসকের সঙ্গ পেতে পারেন। এ পর্যায়ে চিকিৎসক রোগীর বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ উল্লেখযোগ্য যে চিহ্নগুলো পর্যবেক্ষণ করেন তা হলো :
১. রোগীর ওজন বৃদ্ধি-সংক্রান্ত বা হ্রাস-সংক্রান্ত কোনো বিষয় চিহ্নিত হচ্ছে কি না;
২. রোগীর রাগ কোন পর্যায়ে থাকে;
৩. নিজের বা অন্যের জন্য রোগীর ব্যবহারিক আচরণ ভীতিকর কি না;
৪. রোগীর ব্যক্তিগত যত্ন, চিকিৎসকের পরামর্শ এবং উপদেশ গ্রহণের মতো যথেষ্ট মানসিক শক্তি আছে কি না।
যারা এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মোটামুটি সংযত রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যাদের এর বাইরেও ভীতিকর ও ব্যক্তিগত অসহনীয় আচরণের প্রকাশ ঘটে, তাদের ক্ষেত্রে হাসপাতালে স্থানান্তর হওয়াই বিবেচ্য। এতে করে রোগীকে অধিক মনোযোগের সঙ্গে চিকিৎসকরা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে পারেন। খুবই স্পর্শকাতর রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের বেশি সময় দিতে হতে পারে।
চিকিৎসার ধারা
তিনটি ধারায় বিষণ্ণতার চিকিৎসা হতে পারে। প্রথম ধারাটি হলো চিকিৎসা, যা ওষুধ-সংক্রান্ত এবং থেরাপি-নির্ভর হতে পারে। দ্বিতীয় ধারাটি হলো চিকিৎসার ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ ক্রমগতিশীল অবস্থা এবং তৃতীয় ধারাটি হলো ভবিষ্যতে যাতে এই সমস্যা আবার দেখা না দেয়, সে হিসেবে চিকিৎসাপদ্ধতি প্রণয়ন। সাধারণ ওষুধের মধ্যে অ্যান্টিডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতাবিরোধী ওষুধ দেওয়া হয়। ট্রিপটিন, লুডিওমিল, সেন্ট্রি, মেরিপ্রামিন ইত্যাদি নামে আমাদের দেশে এ রোগের ওষুধ পাওয়া যায়।
লেখিকা : সহযোগী অধ্যাপিকা, ফার্মাকোলজি অ্যান্ড থেরাপিউটিক্স, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ।