সঞ্জীবনী
তবু এগিয়ে যাচ্ছে জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/06/28/photo-1435473374.jpg)
ক্যানসার একটি মারাত্মক ঘাতকব্যাধি। বিশ্বজুড়েই এই রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুহার আশঙ্কাজনক। ক্যানসার নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল।
এখানে চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি ক্যানসার বিষয়ে গবেষণা এবং উচ্চপর্যায়ের পাঠদান করা হয়। ৩০০ শয্যার এই হাসপাতালে রোগীদের ক্যানসারের প্রায় সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
যেভাবে শুরু
১৯৮২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্যানসার ওয়ার্ডের টিনশেড রুমে এই ইনস্টিটিউট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় (বর্তমানে যেটি নিউক্লিয়ার মেডিসিন এবং শহীদ মিলন হল)। ইনস্টিটিউটের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান,অধ্যাপক ডা. এস কে গোলাম মোস্তফা বলেন, ক্যানসার প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই আছে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান একে চিহ্নিত করতে পেরেছে আধুনিক যুগে। আমাদের দেশে পাকিস্তান আমলেও এর চিকিৎসা ছিল। সে সময় কয়েকটি চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল। সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডিপ এক্সরে মেশিন ছিল। এই মেশিনে রোগ নির্ণয় করা হয়। সেটার একটু উঁচু পর্যায়ের মেশিন (সিসিয়াম-৩৭) আমাদের দেশে আসে ১৯৬৮ সালে।
স্বাধীনতার পর থেকে যখন বিভিন্ন ইনস্টিটিউট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হলো, তখন এই হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর প্রথম প্রকল্প পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক আবদুর রহীম।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে শুরুর পর ক্যানসার ইনস্টিটিউটের জন্য জায়গা নির্ধারণ হয় শেরেবাংলা নগরে। তবে সেখানে আর তৈরি হয়নি। পরবর্তী সময়ে মহাখালীর টিবি হাসপাতালের কিছু জায়গায় এই স্থাপনা নির্দিষ্ট হয়। এখানে প্রথমে ‘রোটারি ক্যানসার ডিটেকশন সেন্টার’ নামে একটি ভবন করা হয়। রোটারি ক্লাব বাংলাদেশ, ঢাকা ভবনটি করে দেয়। ওই ভবনেই হাসপাতালের কার্যক্রম অনেক বছর চলে। ওখানে রোগনির্ণয়, আউটডোর সার্ভিস এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হতো। তবে চিকিৎসা চালু করা যায়নি।
১৯৯০ সালে বর্তমান বি ব্লকের পাঁচতলা ভবন তৈরি হয়। এর চার ও পাঁচতলায় বিভিন্ন বিভাগ এবং দোতলায় ওয়ার্ড হলো। তখন ৫০ বেডের ওয়ার্ড ছিল। এখন ভবন তিনটি। ২০০৯ সালে এসে খোলা হয় ১৫০ শয্যার সি ব্লক। এ বছরের মার্চ মাসে এটি ৩০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়।
এখানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পোস্টগ্রাজুয়েট কোর্সের ট্রেনিং করা হয়। শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ৫০ জনের মতো, তাঁরা ক্যানসার সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করেন।
চিকিৎসাসেবা
ক্যানসারের চিকিৎসা প্রধানত তিন ভাগে করা হয়- সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি। মস্তিষ্ক এবং ফুসফুস ছাড়া সব ধরনের সার্জারি করা হয়।
ইনডোর এবং আউটডোর মিলিয়ে প্রায় ৫০০ জন রোগী প্রতিদিন সেবা নিতে পারেন। এ ছাড়া বহির্বিভাগে প্রায় ৪০০ রোগীকে প্রতিদিন রেডিয়েশন দেওয়া হয়। কেমোথেরাপির ক্ষেত্রে ১৫০ জন রোগীকে ডে-কেয়ার ভিত্তিতে আউটডোরে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এ হাসপাতালের চারটি বিভাগ রয়েছে : ইনডোর, আউটডোর, পোস্ট অপারেটিভ ও ইমার্জেন্সি। আউটডোরে সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এই হাসপাতাল বিশেষভাবে ক্যানসার সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে। এ জন্য দুজন পরামর্শক আছেন। আউটডোরে এলে রোগীকে প্রথমে তাদের কাছে পাঠানো হয়। কেন এই রোগ হয়েছে, চিকিৎসা প্রক্রিয়া এবং তা সঠিকভাবে পালন করার বিষয়ে তাঁরা পরামর্শ দেন। এ ছাড়া সপ্তাহে একদিন বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকরা মিলে পরামর্শ দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন রোগীর ওপর গবেষণা করা হয়।
রোগী যদি দরিদ্র হন এবং জনপ্রতিনিধির সার্টিফিকেট দেখান, তখন বিশেষ বিবেচনায় যেকোনো চিকিৎসা ফ্রি করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের জন্য চারটি বেডসহ ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিকিৎসাও ফ্রি।
সোনারগাঁও থেকে এসেছেন রহিমা বেগম, তাঁর জরায়ুতে ক্যানসার। দুই মাস ধরে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি জানান, ‘সরকারি হাসপাতাল বলে এখানে চিকিৎসার খরচ কম, চিকিৎসকরাও সহযোগিতা করেন।’
চিকিৎসা ব্যয়
শুরুতে ১০ টাকা দিয়ে প্রথমে টিকিট কাটতে হয়। শয্যা ভাড়া ২৮৫ টাকা। কেবিন ৭৫০ টাকা। এখানকার ৬০ শতাংশ শয্যা ভাড়া দেওয়া হয়। বাকি ৪০ শতাংশ শয্যা বিনামূল্যে দরিদ্র রোগীদের জন্য রাখা হয়েছে। বিনামূল্যে চিকিৎসা করতে হলে পরিচালকের অনুমতি নিতে হয়।
আছে নানা সংকট, তবুও
ইনস্টিটিউটের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এস কে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারী মোট ৩৩২ জন। তবে সৃষ্ট পদের সংখ্যা ৮১৩। অনেক পদে এখনো নিয়োগ সম্পন্ন হয়নি। বর্তমানে আছেন ১৯৫ জন চিকিৎসক, তবে পদ রয়েছে ২২৫টি। নার্সের পদ ২৪৫টি, আছেন ১০৩ জন। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী ১৮৫ জন, পদ ২৭৭টি।
এসব তথ্য জানিয়ে ডা. মোস্তফা বলেন, বর্তমানে হাসপাতাল ৩০০ শয্যায় উন্নীত হওয়ার পর জনবলের সংকট বেড়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, ‘হাসপাতালের টাকা আসে সম্পূর্ণ সরকারি তহবিল থেকে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এই বরাদ্দ কম।’
ঢাকার জিঞ্জিরা থেকে এসেছেন মো. ইদরিস। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত তিনি। জানালেন, ‘এখানে সহজে সিট পাওয়া যায় না। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অনেক দিন ঘোরাঘুরি করতে হয়। তবে এখানে খরচ কম।’
এ প্রসঙ্গে ডা. এস কে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘যেহেতু বেড সংখ্যা সীমিত, তাই সব রোগীকে সব সময় সেবা দেওয়া যায় না। ৩০০ শয্যায় উন্নীত হওয়ার পর হয়তো কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে সব নয়।’
গোলাম মোস্তফা জানান, ‘দেশে মানুষ প্রায় ১৬ কোটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, আমাদের দেশে প্রায় ১৩ লাখ লোক ক্যানসারে আক্রান্ত। এর ৭০ শতাংশ রোগীর চিকিৎসার কোনো কোনো পর্যায়ে রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়। অথচ আমাদের এ মেশিন আছে মাত্র দুটি।’
গোলাম মোস্তফার মতে, ‘অন্যান্য জায়গায় এ রোগের চিকিৎসায় ১০ গুণ বেশি খরচ হয়। এদিকে সারা দেশের ক্যানসার রোগীর জন্য মাত্র ৩০০ শয্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্য। যাঁরা কেমোথেরাপি নেন, তাঁদের দীর্ঘদিন ধরে আসা-যাওয়া করতে হয়। দেখা যায়, ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীদের হোটেলে জায়গা দিতে চায় না, কারণ এ ধরনের রোগীর শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। আর আউটডোরে সব চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। তারা সিট পেলে ভর্তি হয়। নয়তো কয়েক দিন সিটের জন্য ঘোরাঘুরি করতে হয়। মোটামুটি পর্যায়ে নেওয়ার জন্যও এই হাসপাতালে পাঁচ হাজার শয্যা প্রয়োজন।’
রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এস কে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ক্যানসারের রোগীরা বেশির ভাগই দরিদ্র এবং এর চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। রোগনির্ণয়ের বিষয়টি ফ্রি করা দরকার। শয্যার পরিমাণ বাড়ানো দরকার। ক্যানসার বেড়ে গেলে নির্মূল করা কঠিন হয়। ভালো হয় প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে পারলে।’
গোলাম মোস্তফা বলেন, এসব বাধা নিয়েই তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছে। এবং চেষ্টা করছেন সব সমস্যা কাটিয়ে ভালো কিছু করার। ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার ব্যাপারে সহযোগিতার মনোভাব তৈরি করতে পারলে আরো ভালো করা সম্ভব বলে মত দেন অভিজ্ঞ চিকিৎসক গোলাম মোস্তফা।
যোগাযোগ
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ অ্যান্ড হাসপাতাল
মহাখালী, ঢাকা ১২১২
ফোন : ৯৮৮০০৭৮, ৮৮৪৬১-৬৫
Email: info@nicrhbd.org
Website: www.nicrhbd.org