সাক্ষাৎকার
সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো ফিজিওথেরাপিস্ট নেই : ডা. দলিলুর রহমান
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/08/30/photo-1504079179.jpg)
বাংলাদেশ ফিজিক্যালথেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. দলিলুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন লক্ষ্মীপুরে। মান্দারী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৯১ সালে এসএসসি পাস করেন। নটর ডেম কলেজ থেকে ১৯৯৩ সালে এইচএসসি পাস করেন।
২০০০ সালে জাতীয় অর্থপেডিক প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদ থেকে ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৭ সালে মাস্টার অব হেলথ সায়েন্স ইন ফিজিওথেরাপি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন ইউনিভার্সিটি অব সিডনি অস্ট্রেলিয়া থেকে।
কর্মজীবনে তিনি আমেরিকান স্পেশালিটি হসপিটালের সিনিয়র কনসাল্ট অব ফিজিক্যালথেরাপি, ন্যাশনাল ফুটবল টিমের কনসালট্যান্ট ফিজিও, ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান এবং গণস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যলয়ের সিনিয়র লেকচারারসহ অনেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন।
দলিলুর রহমানের নেতৃত্বে সম্প্রতি চিকুনগুনিয়া-পরবর্তী ব্যথা নিরাময় ও শারীরিক অক্ষমতা প্রতিরোধে বেসরকারিভাবে বিনামূল্যে বা খুব কমমূল্যে ১৫টি সেবাকেন্দ্র চালু হয়েছে।
সরকারিভাবেও বাংলাদেশ ফিজিক্যালথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন ও স্বাধীনতা ফিজিওথেরাপিস্ট পরিষদ মিলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বিনামূল্যে চিকুনগুনিয়া-পরবর্তী ব্যথায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। ৫৭টি ওয়ার্ডে ৩১ জুলাই থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন হওয়া সেই কর্মসূচিরও প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন দলিলুর রহমান।
সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কথা হয় তাঁর শিক্ষা, কর্মজীবন এবং চিকুনগুনিয়া-পরবর্তী শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাশ্বতী মাথিন।
এনটিভি অনলাইন : আপনার শিক্ষাজীবন নিয়ে বলুন...
দলিলুর রহমান : আমার স্কুলজীবন শুরু হয় ১৯৮১ সালে আমার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের মান্দারী বাজারের উত্তরে বটতলী গ্রামে। আমার গ্রামের বাড়িতে অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েছে। তার মধ্যে ১৯০১ সালে একটি কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নাম বটতলী আশরাফুল মাদারেজ। এটি ১১৬ বছর আগের প্রতিষ্ঠান। সেই সময় উপমহাদেশে যে কয়জন আলেম ছিলেন, আমার দাদা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আমার বাড়ির সঙ্গে ১৯১০ সালেই প্রতিষ্ঠিত হয় বটতলী সরকারি প্রাইমারি স্কুল। ওই স্কুল থেকে আমার পড়াশোনা শুরু হয়। ওইখানে গ্রামে থেকেও ক্লাস থ্রি, ক্লাস ফোর, ক্লাস ফাইভ স্কলারশিপ পেয়েছি। আমার জেলাতে আমি সব সময় প্রথম না হলেও সেকেন্ড, থার্ডের মধ্যেই থাকতাম।
ছোটবেলা থেকে মানুষকে সেবা করার একটি প্রবণতা ছিল, জনমানুষের কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত থাকতাম এবং আমি বিভিন্নভাবে সেবা করতাম। আমার যারা জুনিয়র শিক্ষার্থী ছিল, তাদের আমি পড়াতাম। এমনকি আমার ক্লাসমেটদেরও পড়াতাম। বিশেষ করে অঙ্ক, ইংরেজি।
এরপর সেখানে লেখাপড়া শেষ করার পর লক্ষ্মীপুরে সবচেয়ে নামকরা স্কুল লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। আমার বাড়ি থেকে এর দূরত্ব হলো ১২ কিলোমিটারের মতো। ওই খানে আমার আসা-যাওয়ায় খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি সেখানে ছয় মাস নিয়মিত হই। এরপর যাতায়াতজনিত সমস্যার কারণে বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে মান্দারি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এরপর ক্লাস সিক্স থেকে সেকেন্ডারি পর্যন্ত, সব ক্লাসে আমি ফার্স্টবয় ছিলাম। ক্লাস এইটে যে স্কলারশিপ হয়, সেটাতে আমি আমার জেলায় সেকেন্ড হয়েছিলাম। সব ক্লাসে ক্যাপ্টেন ছিলাম। ক্লাস নাইনে এসে বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়া শুরু করি এবং এই সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে সেক্রেটারির দায়িত্ব প্রদান করেন।
আমি এসএসসি পাস করি ১৯৯১ সালে। এসএসসিতে আমি মান্দারী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিই। এটা ১৯৯১ সালের ২৮ এপ্রিল। তখন বাংলাদেশে একটি বড় ঘূর্ণিঝড় হয়। অনেক বড় ঘূর্ণিঝড়। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। আমার তখন এসএসসি পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা স্থগিত হয়। যতো দূর মনে পড়ে, আমরা সাতটি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি। এরপর পরীক্ষা বন্ধ হওয়াতে আমি ঢাকায় চলে আসি আমার বড় ভাইয়ের কাছে। এরপর আবার পরীক্ষার তারিখ ঠিক হয় জুলাই মাসে। এরপর জানা যায়, যে সাতটি পরীক্ষা হয়েছে, এর প্রশ্ন আউট হয়ে গিয়েছিল আগেই। এ জন্য সেসব পরীক্ষা বাতিল করা হয়। নতুন করে আবার পরীক্ষা দিতে হবে। ১০টা বিষয় পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই নটর ডেম কলেজে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেখি।
তখন কুমিল্লা বোর্ড ও যশোর বোর্ডে শিক্ষার্থীরা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে এদের পরীক্ষা দুবার নিতে হয়েছে এবং এদের ফলাফল তখনো বের হয়নি। নটর ডেম কলেজ একটি শর্ত দেয়, এই দুই বিভাগে যারা পরীক্ষা দিয়েছে, তারা পরীক্ষার সিটে বসতে পারবে। এরপর তো এখানে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, সুযোগ পেলাম।
তারা ইন্টারভিউর জন্য ডাকল। এখন যিনি নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফাদার বেনজামিন কস্তা, তিনি তখন আমার ইন্টারভিউ নেন। আমাদের সময় প্রিন্সিপাল ছিলেন ফাদার পিসাতো।
বেনজামিন কস্তা বললেন, ‘আমি এডমিশন দেবো। তবে তুমি যদি প্রথম বিভাগ না পাও, তা হলে ভর্তি বাতিল হবে এবং তোমাকে নটর ডেম কলেজ ছাড়তে হবে।’ কারণ প্রথম বিভাগ ছাড়া তো তারা বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করবে না।
কুমিল্লা ও যশোর বিভাগে যতজন শিক্ষার্থী নেয়, এই শর্তের ওপর নেয়। কুমিল্লা, যশোর বোর্ডের যারা এসেছে, তাদের একসঙ্গে একটি গ্রুপে দেয়। এটি হলো গ্রুপ সিক্স। নটর ডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে গ্রুপ ছিল সাতটি। তারপর আমরা নটর ডেম কলেজে লেখাপড়া শুরু করি। এরপর দুই মাস কি আড়াই মাস পরে আমাদের ফল প্রকাশিত হয় হয়। তবে ওখানে যারা ভর্তি হয়েছিল, জানামতে, সবাই প্রথম বিভাগ পেয়েছে। আমি তখন ৭৩২ নম্বর পেয়েও কুমিল্লা বোর্ডে স্কলারশিপ পেয়েছিলাম, যদিও আমার স্কুলের প্রত্যাশা ছিল যে আমি বোর্ড স্ট্যান্ড হব।
আমি অনেক জায়গায় লেখাপড়া করেছি। নটর ডেম কলেজের যে পড়ানোর ধরন আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে। এখানে শৃঙ্খলার বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। শৃঙ্খলা যে মানুষের জীবনে খুব প্রয়োজন, সেটার ওপর তারা সবচেয়ে জোর দেয়। মানুষের বাস্তব জীবনের সঙ্গে যে বিষয়গুলো সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। এই বিষয়গুলোতে তারা খুব জোর দেয়।
এইচএসসি পরীক্ষার আগে আমার চিকেনপক্স হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, তখন চিকেনপক্স নিয়ে তো অন্যদের সঙ্গে বসা যাবে না। আমার সেন্টার পড়েছে তেজগাঁও কলেজে আর আমি থাকি মতিঝিলে। তেজগাঁও কলেজে প্রিন্সিপালের কাছে দরখাস্ত দিই। তখন আমার জন্য আলাদাভাবে ব্যবস্থা করেছে একটি রুমে। এই রুমের মধ্যে আমাকে একটি মশারি দেওয়া হয়েছে। এর ভেতরে বসে আমাকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে হয়েছে। একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রতিদিন আমাকে গার্ড দিতেন। প্রতিদিনের জন্য আমাকে তখন ৫০০ টাকা করে বাড়তি পে করতে হয়েছে। তবে এই চিকেনপক্সও আমাকে থামাতে পারেনি। আমার নিজের উদ্যমের কারণে আমি পরীক্ষা দিয়েছি। এত চাপের মধ্যেও আমি সব মিলিয়ে ৭১৬ নম্বর পেয়েছিলাম।
পাস করার পর বা পরীক্ষা দেওয়ার পর অনেকে অনেক কোচিং শুরু করে। তবে আমি কোথাও ভর্তি কোচিং করিনি। কোচিং ছাড়াই কিছু পরীক্ষা দিই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষায় অংশ নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফেকাল্টির তত্ত্বাবধায়নে ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি। এর আলাদা পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষা নেয় পঙ্গু হাসপাতাল। যখন পঙ্গু হাসপাতাল পত্রিকায় ভর্তির সার্কুলার দেয়, তখন ডবল ফার্স্ট ক্লাস চায়। সেই ’৯৩-৯৪ সেশনে। তখন আমরা প্রায় ৯২৫ জন পরীক্ষা দিই। সেটা থেকে ২৫ জনকে নির্বাচিত করে। আমি ২৫ জনেও ছিলাম না। ওয়েটিং লিস্টে ছিলাম। ওয়েটিং লিস্টে বোধ হয় দুই-তিন নম্বরে ছিলাম, এরপর ভর্তি হই।
এনটিভি অনলাইন : ফিজিওথেরাপি কেন পছন্দ হলো?
রহমান : তখন ফিজিওথেরাপি নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনো ধারণা ছিল না। এর ধারণা নেওয়ার জন্য আমার নানা বাড়ির পাশে একজন অর্থপেডিকস ডাক্তার ছিলেন, প্রফেসর ইসহাক, তাঁর কাছে যাই। অর্থপেডিকস আর ফিজিওথেরাপি যেহেতু খুব বেশি জড়িত, তাই উনার কাছ থেকে পরামর্শ নিলাম। উনি বললেন,‘এর ভালো ভবিষ্যৎ রয়েছে।’ আর বর্তমানে তো বুঝতেই পারছি এর গুরুত্ব, এর আবশ্যিকতা।
বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি পেশা শুরু হয় ১৯৬০ সালে। এটি শুরু হয় প্রফেসর আবুল হোসেনকে দিয়ে, ১৯৬০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এরপর ১৯৭১ সালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের শারীরিক পুনর্বাসনের জন্য আমেরিকা থেকে অর্থপেডিকসের প্রফেসর আরজে গাস্ট আসেন। ওনার সঙ্গে উনি বিশাল একটি টিম নিয়ে আসেন, যাদের মধ্যে অনেক ফিজিওথেরাপিস্টও ছিলেন, অর্থপেডিকস সার্জনও ছিলেন। এই দেশের লাখ লাখ বাতব্যথা, প্যারালাইসিস ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের যথাযথ চিকিৎসার কথা চিন্তা করে ডা. আরজে গাস্ট বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের অধীনে ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি কোর্সটি পঙ্গু হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে চালু করেন। সেই ধারণা থেকে ডা. ইসহাক আমাকে বলেন, ‘এর একটি ভালো ভবিষ্যৎ রয়েছে এবং অনেক লোকের এটি প্রয়োজন।’ তখন এখানে ভর্তি হই।
ভর্তি হওয়ার পর সরকারি সেশনজটের কারণে চার বছরের কোর্স শেষ করতে লেগে যায় সাত বছর। একে প্রফেশনাল ডিগ্রি বলা হয়। চার বছরে চারটি প্রফেশনাল পরীক্ষা শেষ করতে হয়। ২০০০ সালে এটি শেষ হয়। আমার ফলাফল মোটামুটি ভালোই ছিল, সে জন্য আমাকে অনারারি লেকচার অব ফিজিওথেরাপি পদ দেওয়া হয়। এটি হলো পঙ্গু হাসপাতালে। এরপর আমি এটি কয়েক মাস নিয়মিত করি। পাশাপাশি উত্তরায় একটি প্রাইভেট ফিজিওথেরাপি সেন্টার চালু করি। ২০০১ সালে আমি বিয়ে করি, আমার দুই বছরের জুনিয়র ডা. ইসরাত জাহানকে। আমাদের তিন ছেলে।
এর মধ্যে আমরা আইচি জেনারেল হাসপাতালেও প্র্যাকটিস করতাম। প্র্যাকটিস করার সময় আমি অস্ট্রেলিয়াতে স্টুডেন্ট ভিসায় চেষ্টা করি। ২০০৪ সালে মার্চে স্টুডেন্ট ভিসায় অস্ট্রেলিয়াতে যাই। আমি যাওয়ার পর আমার স্ত্রী, প্রথম সন্তান আমার সঙ্গে জুলাইতে যোগ দেয়। আমি সেখানে সিডনি ইনস্টিটিউট থেকে ম্যানুয়াল থেরাপির ওপর দুই বছরের ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। ডিপ্লোমা শেষ হওয়ার সময় আমি ইউনিভার্সিটি অব সিডনিতে আবেদন করি মাস্টার অব ফিজিওথেরাপির জন্য। সেখানে ভর্তি হই। এরপর ২০০৭ সালে মাস্টার ডিগ্রি শেষ করি। আমার ওইখানে থাকার অনেক সুযোগ ছিল। তবে আমার দেশের প্রতি এক ধরনের টান ছিল।
২০০৭ সালের আগস্টে আমি দেশে আসি। অক্টোবরে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার হিসেবে আমি যোগ দিই। সেখানে আট মাস থাকি। এরপর আমি যোগ দিই ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। এটি ২০০৮ এর জুলাইতে। আমাকে বলা হয়েছিল, ফিজিওথেরাপি ব্যাচেলার ডিগ্রি হিসেবে চালু করবেন। আমার স্ত্রীও সেখানকার লেকচারার ছিল। তারা কয়েক মাস ট্রাই করল মন্ত্রণালয়, ডিজি হেলথে, কোর্সটি চালু করার জন্য। তবে তারা শেষ পর্যন্ত পারেনি। না পারার কারণে আমি দেখলাম, আমার সেখানে কাজ নেই। তখন আমি চিন্তা করলাম, একটু খেলায় কাজ করে দেখি। এরপর ২০০৯ সালে ন্যাশনাল ফুটবল টিমের সঙ্গে সংযুক্ত হই।
২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল ফুটবল টিমের কনসালট্যান্ট ফিজিও ছিলাম। শিক্ষকতার পাশাপাশি আমি সেটিও করতে থাকি। সম্পূর্ণ ফুটবল টিমে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে একটি ভালো সম্পর্ক হয়। এর মধ্যে আমি উত্তরায় আমেরিকান হসপিটালে সিনিয়র কনসালট্যান্ট অব ফিজিওথেরাপি পদে প্র্যাকটিস করতাম। পাশাপাশি আবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সে শর্ট কোর্সের প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলাম। এরপর ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে গুলশানে আমি নিজেই বাংলাদেশ ফিজিক্যালথেরাপি হেলথ কেয়ার নামক প্রতিষ্ঠানটি শুরু করি। তখন থেকে আমি এই প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে হাজার হাজার রোগীর ব্যথা, ফিজিওথেরাপি ও স্পোর্টস ইঞ্জুরি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও চিকিৎসা প্রদান করে আসছি। এ ছাড়া উত্তরাতেও নিয়মিত আমি প্র্যাকটিস করছি। পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং কোর্স দিয়ে যাচ্ছি। আর এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ফিজিক্যালথেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে সংগঠনের কাজ নিয়মিতই করছি।
একটি পত্রিকার গোলটেবিল বৈঠকে। ছবি : সংগৃহীত
এনটিভি অনলাইন : চিকুনগুনিয়া-পরবর্তী ফিজিওথেরাপি নিয়ে আপনারা এখন কীভাবে কাজ করছেন?
রহমান : চিকুনগুনিয়া নিয়ে আমরা দুইভাবে কাজ করি। চিকুনগুনিয়ার পরে বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছিল, বিশেষ করে জয়েন্টে ব্যথা, শরীরের দুর্বলতা, জয়েন্টের জড়তা। এগুলোর কারণে মানুষের চলাচলে অক্ষমতা দেখা দিচ্ছিল—এটা যখন আমাদের কনসার্নে আসে তখন আমরা আমাদের সংগঠন বাংলাদেশ ফিজিক্যালথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন থেকে ঢাকার মধ্যে ১৫টি চিকুনগুনিয়া সাপোর্ট সেন্টার অফিশিয়ালি চালু করি। এযাবৎকালীন ১৫টি সেন্টারের মাধ্যমে আমরা প্রায় ৯৬০ জনের মতো চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করেছি। এসব সেন্টারে রোগীদের বিনামূল্যে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে এবং স্বল্পমূল্যে, ক্ষেত্রবিশেষে বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে মানুষ অনেক উপকৃত হচ্ছে। মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে।
এনটিভি অনলাইন : এই সেন্টার থেকে কি কেবল চিকুনগুনিয়া বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে? নাকি অন্যান্য সমস্যারও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে?
রহমান : চিকুনগুনিয়া ছাড়াও অন্যান্য সমস্যা নিয়েও পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এখন চিকুনগুনিয়ার ওপরই বেশি জোর দিচ্ছি। এমনি জ্বর-পরবর্তী ব্যথায় অল্প সময়ের জন্য শুধু পরামর্শ দেওয়া হয়, যেমন আইসপ্যাক দেওয়া। কীভাবে এটি দিতে হবে, কত সময় ধরে দিতে, শরীরের কোথায় দেওয়া যাবে, কোন ধরনের ব্যায়াম, স্ট্রেচিং করা যাবে, কীভাবে আস্তে আস্তে চলাচল শুরু করবে ইত্যাদি।
চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে আমরা যে কার্যক্রম শুরু করেছি, সেটি দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পাশাপাশি উত্তর সিটি করপোরেশন, দুটোকে অবহিত করি। পরবর্তীকালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেয়। মেয়র সাহেব (মেয়র সাঈদ খোকন) একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে চিকুনগুনিয়া-পরবর্তী যে ব্যথা হয়, এটা কমানোর জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ করার ঘোষণা করেন। মেয়রের এই কমিটমেন্ট বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ফিজিক্যালথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন ও স্বাধীনতা ফিজিওথেরাপিস্ট পরিষদ, এ দুই সংগঠনের সঙ্গে সিটি করপোরেশন বসে চিকুনগুনিয়া ব্যথায় ফিজিওথেরাপি দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরপর ৩১ জুলাই মেয়র সাহেব আনুষ্ঠানিকভাবে সিটি করপোরেশনের অডিটরিয়ামে ‘চিকুনগুনিয়া-পরবর্তী ব্যথায় বিনামূল্যে বাড়িতে গিয়ে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ’ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে চিকুনগুনিয়া-পরবর্তী ব্যথায় আক্রান্ত নাগরিকদের বাড়িতে গিয়ে আমাদের শত শত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক মেয়রের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি পরামর্শ, চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এই কার্যক্রম বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট ওয়ার্ড ৫৭। এটি আবার পাঁচটি জোনে বিভক্ত। এখানে প্রতি ওয়ার্ডে পাঁচজন করে মোট ২৮৫ জন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক দিন-রাত কাজ করেছেন। এর সঙ্গে যোগ হয় পাঁচ জোনের পাঁচজন সমন্বয়কারী। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এই কার্যক্রমকে সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমাকে প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এটি এরই মধ্যে আমরা সফলতার সঙ্গে শেষ করেছি । এই প্রোগ্রাম ঘোষণা করার পর কলসেন্টার থেকে নগরবাসীকে একটি নম্বর দেয়। সঙ্গে সঙ্গে কলসেন্টারে অসংখ্য কল আসা শুরু করে। প্রথম ১০ দিন অনেক কল আসে। তবে এখন অনেক কমে এসেছে। এযাবৎ আমরা সিটি করপোরেশন থেকে প্রায় আড়াই হাজার রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছি।
এনটিভি অনলাইন : উত্তর সিটি করপোরেশনে আপনারা কি কাজ শুরু করেছেন?
রহমান : সেখানে আমাদের প্রস্তাবনা দেওয়া রয়েছে। তবে তারা এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
এনটিভি অনলাইন : আর আপনাদের সংগঠন থেকে কীভাবে কাজ হচ্ছে?
রহমান : সেখানে আমাদের ১৫টি সাপোর্ট সেন্টার কাজ করছে। এই সেন্টার উত্তর করপোরেশন, দক্ষিণ করপোরেশন সব জায়গাতেই রয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : এ উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে আপনাদের কোন ভাবনা কাজ করছিল?
রহমান : আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটি একটি বার্নিং ইস্যু। এর কোনো ফোকাস ছিল না। আমাদের পরিচিত অনেক জ্যেষ্ঠ ডাক্তার আক্রান্ত হয়ে ব্যথা নিয়ে আমাদের কাছে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার জন্য আসতে থাকেন। তাঁরাই বেশি উৎসাহিত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এখানে তো আপনাদেরই ভূমিকা। আপনারা কিছু করছেন না কেন? এরপর ঘরে ঘরে আক্রান্ত জন মানুষের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছিল। আমাদের কাছে এ রকম অসংখ্য রোগী আসা শুরু করেছে। সিটি করপোরেশনের প্রায় ১০ দিন আগে আমাদের কাজ শুরু হয়েছিল।
এনটিভি অনলাইন : এই বিষয়টিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের কাছে কি আপনাদের কোনো চাওয়া রয়েছে?
রহমান : চিকুনগুনিয়া-পরবর্তী যে ব্যথা হচ্ছে বা সমস্যা হচ্ছে, জড়তা আসছে, চলাচলে অক্ষমতা দেখা দিচ্ছে, এ বিষয়ে ডব্লিউএইচওর যে গাইডলাইন, এখানে পরিষ্কার বলা রয়েছে যে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা লাগবেই। অনেক বড় একটি জনগোষ্ঠী এই রোগে আক্রান্ত হয়ে কষ্টকর জীবনযাপন করছে, সরকার থেকে যদি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে জনমানুষের এই কষ্ট লাঘব হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সরকারি যেসব হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি বিভাগ রয়েছে, সেগুলোতে কোনো ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক (ফিজিওথেরাপিস্ট) নেই। শুধু এই রোগীই নয়, বাতব্যথা, প্যারালাইসিস ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা প্রতিকার ও প্রতিরোধে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের কোনো বিকল্প নেই। অথচ সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক (ফিজিওথেরাপিস্ট) নেই। এটি এই ধরনের রোগীদের জন্য নির্মম পরিহাস। উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সাউথ ইস্ট এশিয়ান এলাকায় অসংখ্য মানুষ পঙ্গু হয়েছে। তাই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে যদি প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ঝুঁকি থেকেই যায়।
এনটিভি অনলাইন : ফিজিওথেরাপি কত দিন নিতে হবে চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে?
রহমান : তিন সপ্তাহ, ছয় সপ্তাহ এমনকি তিন মাস পর্যন্ত লাগতে পারে। এর সঙ্গে যাদের আগে সমস্যাগুলো বেশি ছিল, ব্যাকপেইন ছিল বা হাঁটুতে সমস্যা ছিল, পুরোনো যাদের অসুবিধা ছিল, তাদের চিকুনগুনিয়ার পরে ব্যথা বা সমস্যাগুলো অনেকগুণ বেড়ে গেছে। তাদের ক্ষেত্রে এই সময়টা আরো বেশি লাগতে পারে। আর অল্প বয়সের রোগীরা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠছে। প্রবীণ নারীদের সমস্যাটা প্রকট।
প্যারালাইসিস রোগী, পঙ্গু রোগী—এদের যে প্রধান চিকিৎসা, সেটা ফিজিওথেরাপি। এই ধরনের রোগীদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাতে ফিজিওথেরাপির বিকল্প নেই। আমি বলব, এখানে সরকার পুরোটাই অবহেলা করছে। সরকারিভাবে এটি অবহেলিত।
এনটিভি অনলাইন : আপনার জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতা...
রহমান : বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাফল্য আর ব্যর্থতা চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া চলছে। কাজের মধ্যে লেগে আছি। ব্যক্তিগতভাবে বলার মতো ব্যর্থতা নেই, কিন্তু ২৩ বছর ধরে বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি পেশার একজন সংগঠক হিসেবে ব্যর্থতার ঝুলি বয়ে বেড়াচ্ছি। কারণ, বিশ্ব পরিক্রমায় ফিজিওথেরাপি পেশা যে অবস্থানে থাকার কথা, বাংলাদেশে আমরা শত শত চেষ্টা করেও সেখানে নিতে পারছি না। আমরা একটি পক্ষের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছি না। এই অশুভ চক্র সরকারি ক্ষেত্রে বারবার আমাদের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। তাই ৫৭ বছরেও ফিজিওথেরাপির একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হয়নি। কোনো রেগুলেটোরি বডি করতে দেওয়া হয়নি। সরকারি পদ সৃষ্টি কিংবা খালি পদে নিয়োগ পর্যন্ত করতে দেয়নি।
এনটিভি অনলাইন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
রহমান : ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অসংখ্য। এর সঙ্গে বিভিন্ন পেশাজীবী জড়িত। অনেক ফিজিওথেরাপি কলেজ প্রতিষ্ঠান করা। এর জন্য দরকার, বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে অন্তত বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিওথেরাপির বাস্তবায়ন করা। তাহলে বেসরকারিভাবে আমরা অসংখ্য ফিজিওথেরাপি কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে পারব। যেখান থেকে আমরা বিশ্বমানের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক তৈরি করতে পারব। আমি চাই, দেশে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান হোক। এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিশ্বমানের দক্ষ জনবল তৈরি হোক, যারা জনমানুষের জন্য কাজ করবে। এটা আমাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হোক বা যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হোক।
আমার পিএইচডি শুরু করার একান্ত ইচ্ছা আছে এবং আমার স্ত্রী ডা. ইশরাত জাহান ও আমাদের তিন ছেলেকেও শিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি পিএইচডি করাতে চাই। জনমানুষের চলমান কাজ চালিয়ে যেতে চাই।
জীবনে চলার ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে ওপর আমি গুরুত্ব দিই। মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, আত্মবিশ্বাস, কাজে নিষ্ঠা, হাল না ছাড়া, সততা, পাংচুয়ালিটি, সময়, কমিটমেন্ট, নিয়মানুবর্তিতা—এগুলোকে আমি সবচেয়ে বড় বিষয় বলে মনে করি। আমি অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করিনি এবং করব না ।
এনটিভি অনলাইন : সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।