থাইরয়েড ক্যানসার কী, কেন হয়?
থাইরয়েড একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি আমাদের দেহের। এর থেকে নিঃসৃত হরমোন শরীরে বিভিন্ন কাজ করে। আজ ১৩ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১১৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইএনটি এবং হেড নেক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী।
urgentPhoto
প্রশ্ন : থাইরয়েড গ্রন্থিটি কী? এর অবস্থান কোথায়? কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর : থাইরয়েড হলো গলার সামনের দিকে প্রজাপতির মতো একটি গ্রন্থি, এন্ডোক্রাইন গ্ল্যান্ড বলা হয় একে। সেই গ্রন্থি এক ধরনের হরমোন তৈরি করে মানুষের রক্তের মধ্যে সেটা মিশিয়ে দেয়। এবং সেই হরমোন মানব শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গের মধ্যে কিছু কাজ করে। মানুষের বৃদ্ধিতে এবং কার্যক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। বাড়ন্ত বয়সে বুদ্ধিমত্তার ওপরও অনেক প্রভাব ফেলে। এটা মানবদেহের খুব উপকারী একটা উপাদান। তবে এই থাইরয়েড গ্রন্থিও মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন : কী ধরনের অসুস্থ হয়?
উত্তর : সেটা ক্যানসার জাতীয় হতে পারে। ক্যানসার ছাড়াও অন্য রোগ হতে পারে। তবে ক্যানসার ছাড়াই বেশির ভাগ থাইরয়েডের অসুখ হয়। যেমন : হাইপো থাইরয়েডিজম হতে পারে; যেটাতে এই হরমোন নিঃসরণের পরিমাণ কমে যেতে পারে। আবার থাইরটক্সিকোসিস বা হাইপারথাইরয়েডিজম হয়, যেখানে হরমোন নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া থাইরয়েড ম্যালিগনেন্সি বা ক্যানসার হয়।
প্রশ্ন : একজন মানুষের যদি থাইরয়েড গ্রন্থিতে ক্যানসার হয়, তাহলে তিনি বুঝবেন কী করে?
উত্তর : থাইরয়েড ক্যানসার হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ, থাইরয়েড গ্রন্থি যেখানে থাকে, গলার সামনের দিকে নিচের পাশে, সেখানে হয়তো হঠাৎ ফুলে যাবে। ফুললে সেটা রোগী নিজে বা তার কাছের যাঁরা আছেন, তাঁরা বুঝতে পারেন। এধ রনের ফুলে থাকলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : ফুলে থাকা মানেই নিশ্চয় ক্যানসার নয়?
উত্তর : ফুলে থাকা মানেই ক্যানসার নয়। ফুলে থাকা কেন হয়েছে, তার পরীক্ষা করলে হয়তো দেখা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ ক্যানসার। আর বাকিগুলো ক্যানসার নয়। তাই ফোলা দেখলেই ক্যানসার মনে করার কিছু নেই। তবে এ সমস্যায় চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এবং চিকিৎসক পরীক্ষা করেই এটা নিশ্চিত হতে পারবেন যে ক্যানসার হয়েছে কি না।
প্রশ্ন : থাইরয়েড ক্যানসারে একজন মানুষ আক্রান্ত হন কেন? কারা এতে ঝুঁকিপ্রবণ?
উত্তর : থাইরয়েড ক্যানসারের একেবারে সুনির্দিষ্ট কারণ বলা যাবে না। কতগুলো কারণ দেখা যায়, যেগুলো থাইরয়েড ক্যানসারের জন্য দায়ী। টিএসএইচ একটা হরমোন, যেটা থাইরয়েড গ্রন্থিটাকে উদ্দীপ্ত বা স্টিমুলেট করে, সেই থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন যদি বেশি মাত্রায় দীর্ঘদিন ধরে কোনো কারণে কাজ করতে থাকে, তাহলে সেটা থাইরয়েড ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
এ ছাড়া রেডিয়েশন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন ধরনের এক্সরে মেশিন থেকে রেডিয়েশন হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গা যেখানে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটেছে যেমন চেরনোবিল- এসব জায়গায় রেডিয়েশন হয়। এই রেডিয়েশন বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে চলে আসে।
আমরা যেটা বলি, গুঁড়ো দুধ যেগুলো বিদেশ থেকে আসে, বিশেষ করে ইউরোপিয়ান অরিজিন থেকে আসে, আমাদের ধারণা সেগুলোর কারণে থাইরয়েড ক্যানসারের প্রবণতা কিছুটা হলেও বাংলাদেশে বেড়েছে।
প্রশ্ন : কিন্তু সেটা তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই আসে?
উত্তর : সেটা সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত নই। তবে এটা যে হয়ই সেটাও এখনো নিশ্চিত না। তবে আমাদের পর্যবেক্ষণ থাইরয়েড ক্যানসারের রোগী এখন বেশি।
প্রশ্ন : থাইরয়েড ক্যানসার হয়েছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য কী করা হয়?
উত্তর : মূলত অস্ত্রোপচার করতে হয়। এখানে অন্যান্য ক্যানসারের মতো ধাপ বা পর্যায় দেখা হয়। কোন ধাপে রোগীটা এলেন সেটা ঠিক করতে হবে। সেটা ঠিক করেই পরিপূর্ণ চিকিৎসাটা ঠিক করতে হয়। যেমন : এখানে যদি শুধু ছোট হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে তাহলে অস্ত্রোপচার করে ফেলে দিতে পারলেই ঠিক হয়ে যাবে। এখানে একটা কথা বলতে হবে, থাইরয়েড ক্যানসারের চিকিৎসার ফলাফল অন্যান্য অনেক ক্যানসারের চেয়ে অনেক ভালো। দেখা গেছে, থাইরয়েড ক্যানসারের চিকিৎসার পর রোগী স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। এই রোগের কারণে অন্তত তাঁর মৃত্যু হয় না।
এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে অস্ত্রোপচার করলে সেটা সুস্থ হয়ে যায়। তবে যদি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যায়, তাহলে রেডিও অ্যাকটিভ আয়োডিন অ্যাবলেশন করতে হয়।
প্রশ্ন : এর বিষয়টি কী?
উত্তর : রেডিও অ্যাকটিভ আয়োডিন অ্যাবলেশন একধরনের রেডিওথেরাপি। তবে সেটা মেশিন বা এক্সরে দিয়ে করা হয় না। নিউক্লিয়ার মেডিসিনে যেসব থাইরয়েড বিশেষজ্ঞ কাজ করেন, তাঁরা এই ডোজটা ক্যালকুলেট করেন। এখানে একটি আয়োডিন ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। সেই ওষুধটি শরীরে ঢুকে একধরনের বিক্রিয়া করে। এবং থাইরয়েড ক্যানসারের যেসব কোষগুলো মাইক্রোস্কোপির পর্যায়ে থেকে যায়, সেগুলোকে নষ্ট করে দেয়।
প্রশ্ন : ওই সময়টায় রোগীকে বিছিন্ন করে রাখতে হয়...
উত্তর : যেহেতু এটা একধরনের রেডিয়েশন, এখানে যারা সুস্থ দেহের লোকজন তারা অন্তত ২৪ ঘণ্টা রোগীর পাশে না থাকাই ভালো। এ জন্য তাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
প্রশ্ন : কোনো ব্যক্তি যদি সময়মতো এই চিকিৎসা না নেয়, তখন চিকিৎসা কতটা ঝামেলার হতে পারে?
উত্তর : এটা সব সময়ই ছড়ানোর একটা প্রবণতা থাকে। সেটা প্রাথমিকভাবে গলার পাশে যে লিফনোটগুলো থাকে, সেখানে চলে যেতে পারে। আরো অনেকগুলো ফোলা তৈরি হতে পারে। ফুসফুসে ছড়িয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া আরো যদি ছড়ায়, শরীরের হাড় বিশেষ করে মেরুদণ্ড এগুলোতে ছড়িয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন : অস্ত্রোপচার করতে হলে সেই গ্রন্থিটা ফেলে দিতে হয়, সে ক্ষেত্রে ওই কাজটা কীভাবে হবে? এবং এটা তার জন্য ক্ষতি করে কি না?
উত্তর : যখন ক্যানসার হয়ে যায়, তখন সেটাকে রাখার তো কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাই গ্রন্থিকে ফেলে দিতেই হবে। ফেলে দিলে গ্রন্থিটা যেসব হরমোন তৈরি করত, সেটা থাকে না। তখন বাজারে যে সিনথেটিক হরমোন পাওয়া যায়, সেগুলো খেতে হবে। সেটা হয়তো সারা জীবনই খেতে হবে। ক্যানসার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য এটুকু কষ্ট তো করতেই হবে। তা ছাড়া বিকল্পভাবে ওই গ্রন্থির কাজ তো চলছেই। ওই ওষুধগুলো রোগী যদি নিয়মিত সেবন করেন, তাহলে শারীরিক কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না। (যে কোনো ওষুধ সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।)