স্ট্রোক-পরবর্তী পুনর্বাসন কেন জরুরি?
মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ কিংবা রক্ত চলাচলে বাধা পড়লে স্ট্রোক হয়। একজন স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে প্রাথমিক ঝুঁকি কাটিয়ে ওঠার পর স্ট্রোক-পরবর্তী পুনর্বাসন জরুরি। আজ ২১ আগস্ট, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১২৭তম পর্বে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নিউইয়র্কের ইস্ট হেভেন নার্সিং হোমে কর্মরত অকুপেশনাল থেরাপিস্ট আক্তার হোসেন।
urgentPhoto
প্রশ্ন : স্ট্রোক বলতে আসলে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : আমাদের মস্তিষ্কে যখন রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় অথবা রক্তক্ষরণ হয়, তখন সাধারণত মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়।
প্রশ্ন : স্ট্রোকের সময় একজন মানুষের লক্ষণগুলো আসলে কী হতে পারে?
উত্তর : প্রথমত, আমরা কী করে বুঝব একজন মানুষের স্ট্রোক হতে যাচ্ছে? একটা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যেরই তাঁর শরীরের অবস্থা জানা উচিত। পরিবারের বাবা-মা বা বয়স্ক ব্যক্তিদের কথাই ধরি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের ধারণা থাকা উচিত, উনি স্ট্রোকের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ, যেকোনো সময় স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সব সময় দেখতে হবে চারটি লক্ষণ। আমরা এখানে বলব, ধরেন হাসতে বললেন কিন্তু সে হাসতে পারছে না, মুখের একদিকের অংশ বেঁকে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে যদি তাকে বলেন, হাত দুটোকে ওপরে ওঠানোর জন্য তখন হয়তো একটা হাত ওপরে উঠে যাবে, একটা নিচে পড়ে যাবে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, এর মধ্যে যদি তাঁকে কথা বলতে বলেন, কথা বললে দেখা যাবে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। আরেকটি লক্ষণ রয়েছে, সেটা হলো সময়। এ রকম হতে থাকলে দেরি না করে তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি নেওয়া যায়, তত তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দেরি হলেই মৃত্যুর ভয় থাকে।
প্রশ্ন : যেটি আমাদের মূল আলোচনার বিষয় স্ট্রোক-পরবর্তী পুনর্বাসন, এটি বলতে কী বোঝাচ্ছে?
উত্তর : একজন রোগী যখন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, তার পরের পর্যায়টা কী? তাঁকে কীভাবে পুনর্বাসন করা হবে, তাঁর সুস্থতার জন্য মূলত এটাই বোঝানো হয়। এ ক্ষেত্রে রোগীকে প্রথমেই হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা দরকার। সেখানে চিকিৎসকের পরামর্শে, যখন তিনি হাসপাতাল থেকে চলে আসবেন, তাঁকে ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপিতে রেফার করতে হবে।
প্রশ্ন : মাঝখানে একটু জানতে চাইব, এই যে ফিজিওথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি দুটো শব্দ আপনি বললেন, এদের পার্থক্য কী?
উত্তর : ফিজিওলজিস্ট তাঁর শরীরের ভারসাম্য, শরীরে নিচের অংশের বিষয়গুলো ঠিক করেন। আর নাভির ওপরের অংশ, দুটো হাত, মস্তিষ্কের অংশ সব অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা ঠিক করেন। আমরা এখানে রোগীর যে অংশটি প্যারালাইজ হয়ে যায়, সেই অংশকে ঠিক করার চেষ্টা করি বিভিন্ন ব্যায়ামের মাধ্যমে, যেমন : পেশির ব্যায়াম।
এখানে একজন মানুষ কীভাবে আবার তাঁর আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন, সেটা আমাদের আরেকটি চেষ্টা। এ ছাড়া তাঁকে বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করতে হবে, যাতে এর সাহায্য নিয়ে আগের জীবনে ফিরতে পারবেন। এভাবেই স্ট্রোক-পরবর্তী পুনর্বাসন করা হয়।
প্রশ্ন : কী পরামর্শ হবে, সেটা কিসের ওপর নির্ভর করে?
উত্তর : রোগীর কোন ক্ষেত্রে কী ডিভাইস প্রয়োজন, এটা নির্ভর করবে তার উন্নতি হওয়ার ওপরে। পর্যায় থেকে পর্যায়ে এটা করা হয়। প্রথমে হয়তো একজন রোগী শোয়া থেকে একটু বসতে পারে একা একা। এর পর তার ভারসাম্যের প্রশিক্ষণ দিই। ভারসাম্যের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর অ্যাম্বুলেশনে নেওয়া হয়। আর অকুপেশনাল থেরাপির ক্ষেত্রে আমরা রোগীর কার্যক্রম দেখি। তাঁর হাতের নড়াচড়া কতটুকু, তাঁর শক্তি আছে কি না সেটা দেখি।
প্রশ্ন : সবার ক্ষেত্রেই কি আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানো সম্ভব?
উত্তর : এটা আসলে অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। ব্যক্তির বয়স কী রকম, তাঁর বয়স যত বেশি হবে, পেশির শক্তি তত কমে যায়। তাঁর উন্নতিটা তখন ধীরে হয়। আর তরুণ বয়সে স্ট্রোক করলে দ্রুত ভালো হয়। পেশির শক্তি থাকে। মানসিকভাবে দৃঢ় থাকে। সবকিছুর ওপরেই আসলে উন্নতি নির্ভর করে।
প্রশ্ন : অনেক প্যারালাইজড রোগী থাকেন, যাঁদের দেহের একপাশ সম্পূর্ণ অকার্যকর। এ ধরনের রোগীকে আসলে কী পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
উত্তর : অনেক রোগীরই একদিক সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে। যদি কারো মস্তিষ্কের ডান দিকে স্ট্রোক হয়, তাহলে দেহের বাঁ অংশ প্যারালাইজড হয়ে যায়। আবার যদি মস্তিষ্কের বাঁ দিকে স্ট্রোক করে, তাহলে দেহের ডান অংশ প্যারালাইজড হবে। কীভাবে বুঝবেন, একজন রোগীর দেহের এক অংশ অকার্যকর? আপনি যদি তাঁকে খেতে দেন, যদি তাঁর ডান দিক ভালো থাকে বাঁ দিক দুর্বল থাকে, তখন দেখা যাবে সে ডান দিকের খাবারগুলোই সব খেয়ে ফেলছে। কিন্তু বাঁ দিকে খাবারগুলো রয়ে গেছে। কারণ বাঁ দিকে যে তাঁর সামনে কোনো বস্তু রয়েছে, এটা সে বুঝতে পারছে না। এমনকি তাঁকে ডাক দিলেও সে ডান দিকেই তাকাবে। কারণ সে ভাবছে, এই অংশটিই তার শুধু আছে, অপর অংশটি নেই।
এই বিষয়টি ঠিক করার জন্য তাঁকে অকার্যকর অংশের সামনে খাবার দিতে হবে। সেই পাশে দাঁড়াতে হবে। জড়তা কাটানোর জন্য ওই পাশে হাত দিতে হবে। তাঁর চিবুকে হাত দিয়ে বাঁ দিকে মুখ ঘোরাতে হবে। এভাবে কাজগুলো করে বুঝতে দিতে হবে, তার বাঁ পাশে কিছু রয়েছে।
প্রশ্ন : রোগীর অনেক আত্মীয়স্বজনই জানেন না, পুনর্বাসন বলে একটা বিষয় রয়েছে। অনেকে অকুপেশনাল থেরাপি বলেই যে একটা জিনিস আছে, সেটার বিষয়ে জানেন না। এ ক্ষেত্রে মানুষকে জানানোর বিষয়ে চিকিৎসকদের কী ভূমিকা রয়েছে?
উত্তর : এখানে চিকিৎসকদের ভূমিকা অনেক বেশি বলে আমি মনে করি। কারণ চিকিৎসকরা আমাদের কাছে রোগী রেফার করেন। উদ্দেশ্য এটাই যে, ওষুধের পাশাপাশি তাঁর পুনর্বাসনও দরকার। তাঁর ব্যায়াম প্রয়োজন, বিভিন্ন কার্যক্রম প্রয়োজন। তাঁর মানসিক কাউন্সেলিং প্রয়োজন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ প্রয়োজন থেরাপিস্টদের। সবকিছু সবার সঙ্গে মিলেই আমরা রোগীকে সারিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে কাজ করি। আমাদের মূল বিষয়টা হলো, একজন রোগীকে ভালো করতে হবে। কারণ, আমরা রোগীর মাধ্যমেই আয় করছি। তাই রোগীর মূল্যায়ন করতে হবে সবার ওপরে। তাঁর প্রতি ভালোবাসা আমাদের ভেতর থেকে আসতে হবে। সবকিছু মিলে আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে। তাৎক্ষণিক মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে চিকিৎসকরা আসলে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন, তবে স্ট্রোক-পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য থেরাপিস্টদের কাছে রোগীদের পাঠাতে হবে। সুস্থতার জন্য মেডিসিন ও থেরাপিস্ট—সবকিছুরই প্রয়োজন রয়েছে।