রোজায় ভেজাল খাবার এড়াতে করণীয়
ভেজাল নিয়ে বাংলাদেশে খাদ্যে মানুষের মধ্যে দিনকে দিন বাড়ছে উদ্বেগ। বিশেষ করে রমজান মাসে ইফতারের জন্য দোকানের খাবার কিনে খাওয়ার প্রবণতার কারণে এ উদ্বেগ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি। ঢাকার রাস্তার পাশে ফুটপাতে নোংরা স্থানে চুলা বসিয়ে প্রতিদিনই ইফতারী পণ্য ভাজা হয়। তবে সেদিকে যেমন বিক্রিতার ভ্রূক্ষেপ থাকে না, তেমনি ক্রেতারও অভাব নেই।
রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের আগে কয়েকটি তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে শুকনো খেজুর অর্থাৎ খোরমা দিয়ে ইফতার করতেন। আর যদি তাও না পেতেন, তাহলে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন।
আমরা অবশ্য ইফতারে খোরমা খেজুর বা শরবত ও দুধকে একটি অনুসঙ্গ হিসেবে রাখলেও এরপরই যুক্ত করেছি নানারকম খাবার। তবে ইফতারিতে যেখানে খাওয়া দরকার সহজপাচ্য খাবার, সেখানে আমরা খাই মুখরোচক বলে গুরুপাক সব সামগ্রী, যার মধ্যে তেলে ভাজা খাবারই প্রধান। এ কারণে অধিকাংশ মানুষই বদহজমে ভুগেন। সারাদিনের অভুক্ত পাকস্থলীতে গুরুপাক খাবার স্বাভাবিকভাবেই সমস্যা তৈরি করে।
অনেকেই মনে করে, ইফতারে আল্লাহতায়ালার বরকত ও রহমত রয়েছে। তাই ভেজাল খেলেও খুব একটা কিছু হবে না। এটি আসলে শুধুমাত্র সান্তনা। আসলে ইসলাম ধর্মে ভেজালকে ব্যবসায় হারাম করা হয়েছে। কাজেই ভেজাল খাবার দিয়ে ভেজাল ব্যবসা মোটেও উচিত নয়। আর ভেজাল বা ক্ষতিকর খাবার খেলে শরীরতো তার প্রতিক্রিয়া দেখাবেই।
রোজার পুষ্টির সবচেয়ে বিশেষ দিক হলো সুষম, পরিমিত খাদ্যগ্রহণ এবং এই সুষম খাদ্য হতে হবে হালাল ও নিরাপদ। ক্রেতা বিক্রেতা সচেতনতা ও ভেজাল প্রতিরোধে নীচের বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত।
খেসারির ডাল পরিহার
রোজাকে কেন্দ্র করে খেসারি ডালের বিক্রি বেড়ে যায় অনেক। পেঁয়াজু, বেগুণি তৈরিতে এর ব্যবহার অনেক। এই খেসারির ডাল ল্যাথরিজম, প্যারালাইসিসের জন্য দায়ী। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফল মেডিকেল রিসার্চ এই ডাল চাষ বন্ধ ঘোষণা করে। রোজায় এই ডালের গ্রহণ ও ব্যবহার যদি বেড়ে যায় তা স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
পেঁয়াজু তৈরিতে সতর্কতা
রং, খেসারির ডাল, পুরোনো তেল দিয়ে তৈরি। এই পেঁয়াজু প্রয়োজনীয় পুষ্টির তুলনায় শারীরিক ক্ষতি করে বেশি। খেসারির ডাল শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। গ্রীষ্মে নানা রকম সবজি বাজারে পাওয়া যায়। এটি সামান্য মশলা ও আটা বা ময়দা দিয়ে মাখিয়ে বড়া তৈরি করা হলে তা থেকে কিছু পুষ্টি পাওয়া যাবে। এতে খেসারির ডালের ক্ষতি থেকে শরীরকে রক্ষা করা যাবে।
বেসনের বিকল্প
রোজায় ভাজা খাদ্য তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বেসন। আর এই বেসনটাই হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ,বেসনের মূল উপাদান ডাল হলেও এর পরিবর্তে নানা ভেজাল উপকরণ দিয়ে তৈরি হয় এই বেসন। তাই তেলে ভাজা খাবারে বেসনের পরিবর্তে আটা বা ময়দা ব্যবহারই শ্রেয়। এ ছাড়া অর্থের দিক দিয়ে সাশ্রয়ী। রোজায় ক্রমাগত বেসন খাওয়ার কারণে রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বাড়ে এবং কিডনি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, বেসনে তৈরি খাদ্যের পাশাপাশি ছোলা ও পেঁয়াজু মূলত দ্বিতীয় শ্রেণির প্রোটিন। তাই সব মিলিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির প্রোটিন বেশি খাওয়ায় কিডনির ওপর চাপ পড়ে।
ভেজাল তেলের ব্যবহার কমানো
তেলে ভেজাল খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। রোজার সময় আবার এই ভেজাল তেলকে আরো ভেজাল এবং অনিরাপদ করে তুলে বিক্রেতারা। পাকস্থলীর ক্যানসার, এসিডিটি, আলসারের অন্যতম কারণ এই পুরনো তেল। বেশিরভাগ রাস্তার খাবারই ভাজা হয় পুরনো তেলে।
একই তেলে বার বার ভাজার কারণে তেল যখন মেঘের মতো দেখাবে এবং ভাজার সময় ফেনা উঠবে তখন বুঝতে হবে তেলটি শরীরের জন্য খুবই বিপদজনক। এই তেলের ধোয়া চোখের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। এমনকি ভাজার সময় এর গন্ধ নাকে গেলে তা থেকেও ক্ষতি হয়।
এই তেল খেলে শরীরের ফ্রি রেডিকেলস তৈরি হয়। এটি ক্যাসার, নার্ভের সমস্যা, কিডনি সমস্যার জন্য দায়ী। এ ছাড়া ফ্রি রেডিকেলস হার্ট এর কোষের ক্ষতি করে এবং রক্তনালীতে চর্বি জমে ব্লক করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া এই ফ্রি রেডিকেলস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমিয়ে দেয়। তাই
- পরিমাণমত তেল ব্যবহার করে ভাজা
- ডুবো তেলে ভাজার পরিবর্তে হালকা তেলে ভাজা
- ভাজা তেল দ্বিতীয়বার ব্যবহার করলে অতিরিক্ত তাপ না দেয়া বা সেটি থেকে বেশি ধোঁয়া বের হলে তা ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।
- দ্বিতীয়বার ব্যবহারের প্রয়োজন হলে তেলকে প্রথমে ঠান্ডা করে নিতে হবে। এরপর ফিল্টার কাগজ দিয়ে ছেঁকে একটি পাত্রে যথাযথভাবে ঢেকে সংরক্ষণ করতে হবে।
খাবারে কৃত্রিম রং না মেশানো
খাবারে কৃত্রিম রং ব্যবহার থেকে বিরত থাকা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি। কৃত্রিম রং থেকে শরীরের নানা ক্ষতি হয়। বিশেষ করে কিডনি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে। কৃত্রিম রং মেশানো খাবার গ্রহণ করার কারণে মাইগ্রেন, ত্বকে সমস্যা ও শিশুদের মনোযোগের অভাব লক্ষ্য করা যায়।
পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ, বুন্দিয়া, জিলাপি ইত্যাদি ইফতারগুলোকে অনেক রঙ্গীন করার জন্য রং এর ব্যবহার এখন খুবই সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই-
পেঁয়াজু, বেগুণি, চপ এর রঙের পরিবর্তে সাধারণ হলুদ ও মরিচের ব্যবহার করা যেতে পারে।
জিলাপিতে কোনো ধরনের রং ব্যবহার না করা অর্থাৎ প্রাকৃতিক রং বজায় রাখা।
ক্রেতাদেরও অতিরিক্ত রঙিন খাবারের প্রতি আকর্ষণ কমাতে হবে।
ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার থেকে বিরত থাকা
ভেজালমুক্ত খাবারকেও তৈরির সময় কিছু অস্বাস্থ্যকর উপাদান ব্যবহার করে খাবারটিকে অনিরাপদ করে তোলা হয়। যেমন-
টেস্টিং সল্ট
খাদ্যের স্বাদ বাড়ানোর এই উপাদানটি স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। নার্ভের সমস্যা, মাইগ্রেন, ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ,ছাড়াও আরো নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায় এই টেস্টিং সল্ট। তাই এর ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। টেস্টিং সল্টের পরিবর্তে সাধারণ কিছু মসলা ব্যবহার করা খাবারকে অনেক সুস্বাদু করা যায়।
খাবার সোডা
খাবারে সোডা ব্যবহার গ্রহণযোগ্য অতিরিক্ত খাবার সোডা ব্যবহার মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
বিকল্প খাবার
রোজায় পেঁয়াজু অনেকেরই একটু প্রিয় খাবার। আর থাকেই থাকে যত ভেজাল। তাই পেঁয়াজুর পরিবর্তে শাকের বড়া বা সাগুর বড়া বিকল্প হিসেবে খাওয়া যেতে পারে।
এ ছাড়া পেঁয়াজু তৈরিতে যে ডাল ব্যবহার করা হয় তাতে স্বাস্থ্যসম্মত ডালকে ন্যূনতম ছয় ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
মুড়ির পরিবর্তে চিড়া/ ভুট্টা ইফতারের তালিকায় যোগ করা যেতে পারে।
হালিম
রোজায় হালিম খুবই পছন্দের একটি খাবার। তবে এই হালিম যথাযথভাবে তৈরি হচ্ছে কি না সেদিকে নজর দেয়া জরুরি। হালিমের মধ্যে বয়সী মাংস ব্যবহার না করা, খেসারির ডাল এবং টেস্টিং সল্ট ব্যবহার না করা, বার বার ভাজা তেলে পেঁয়াজ ভেজে ওই পেঁয়াজ হালিমের ওপর না দেয়া, কৃত্রিম রং এবং অতিরিক্ত তেল ব্যবহার না করা একটি আদর্শ হালিমের বৈশিষ্ট্য। উচ্ছিষ্ট হালিম পরের দিনের নতুন হালিমের সঙ্গে না মেশানো। যে পাত্রে হালিম রান্না করা হয় তা প্রতিদিন ধোয়া।
ছোলা
রাস্তার ইফতারে ছোলা একটি জনপ্রিয় খাবার। পুষ্টির দিক থেকে ছোলা অনেক স্বাস্থ্যকর হলেও অতিরিক্ত মশলা ও তেলের ব্যবহারে এই স্বাস্থ্যসম্মত খাবারটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। বার বার ভাজা তেল দিয়ে ছোলা রান্না করা, ছোলার মধ্যে না ধুয়ে শসা ও পেঁয়াজ ব্যবহার করা, উচ্ছিস্ট ছোলাকে পরের দিন আবার নতুন ছোলার সঙ্গে মেশানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সিদ্ধ আলু, চাট মশলা, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ মিক্স করে খাওয়া।
এ ছাড়াও ইফতারকে স্বা্স্থ্য সম্মত বিক্রি করার জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলা খুবই জরুরি। যেমন :
- খাদ্য তৈরির সময় হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করা এবং মাথা ঢেকে রাখা।
- খাদ্য বিক্রির সময় হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করা।
- প্লাস্টিকের বক্স বা পলিথিনে গরম খাবার বিক্রি না করা।
- প্রত্যেকটি খাবারই ঢেকে রাখা।
পানীয়
ইফতারের প্রথম খাবারটি হচ্ছে যে কোনো তরল। রঙ্গীন তরল বা জুস কতটা স্বাস্থ্যকর সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। স্যাকরিন বা কোন কৃত্রিম রং ব্যবহার না করা, বাজারজাত তরলের পরিবর্তে তোকমাদানার শরবত, ইসুবগুলের শরবত, বেলের শরবত, লেবু পানি ইত্যাদি প্রাকৃতিক তরল স্বাস্থ্যসম্মত হয়ে থাকে।
ফুটানো পানি
থালা- বাসন ধোয়া থেকে শুরু করে ইফতারের সব খাবার তৈরিতেই ফুটানো পানি ব্যবহার করা। এমনকি যেসব খাবার যেমন- ধনিয়া পাতা, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, শশা, খেজুর অর্থাৎ যেগুলো সরাসরি খাওয়া হয় তাও ফুটানো পানি দিয়ে ধোয়া অত্যন্ত জরুরি।
ভেজালমুক্ত ইফতার সুস্থ শরীর
মাহে রমজান মানে হচ্ছে সংযমের মাস। কাজেই ব্যবসায়ীদের যেমন সংযমী হওয়ার প্রয়োজন তেমনি ভোক্তাদেরও বাহারি খাবার থেকে সংযমি হতে হবে। হালাল ব্যবসা ও হালাল খাবারের জন্য জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড জোরদার করতে হবে। তাই অস্বাস্থ্যকর খাবারের জনপ্রিয়তা কমানো এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের প্রচারণা বাড়ানোর মাধ্যমে ইফতারে রোজাদারের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। কারণ, বিক্রেতার যেমন মনে রাখতে তিনি নিজে এবং পরিবারও এই ভেজাল খাবারের শিকার হচ্ছেন। আর যারা বাধ্য হয়ে এসব কিনে খাচ্ছেন, তাদেরও সচেতন হওয়া জরুরি। কারণ, আপনি চাইলেই এসব ভেজাল পরিহার করা স্বাস্থ্যসম্মত বিকল্প খাবার বেছে নিতে পারেন। ক্রেতা হারালে বিক্রেতারাও সচেতন হবেন। সবার নিজে নিজে জায়গা থেকে এই চেষ্টাটা এখন সময়ের দাবি। নিজে সুস্থ থাকুন, অন্যকে সুস্থ রাখুন।
লেখক : প্রধান পুষ্টিবিদ, অ্যাপোলো হাসপাতাল