ভ্রমণে সুস্থ থাকার উপায়
ঈদের মৌসুম। চলছে ভ্রমণের আয়োজন। প্রিয়জনের সাথে উৎসব পার্বণ কাটাতে মরিয়া মানুষেরা তাই হয়েছেন ঘরমুখো। এই লেখা যখন আপনার হাতে - হতে পারে আপনি তখন ব্যাগপত্র গুছিয়ে ভ্রমণে। হতে পারে বাসে কিংবা ট্রেনে। অথবা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বেরিয়ে পড়বার জন্য। কেউ কেউ ঈদরে পর ছুটি কাটাতে বেরিয়ে পড়বেন আনন্দ ভ্রমণে।
আবহাওয়াটা ভালো নয়। গরমের এই সময়টায় ভ্রমণে হতে পারে অনেক ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা। অসুখ বিসুখে ভ্রমণের আনন্দটাই যেন মাটি না হয়ে যায় তার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
মোশন সিকনেস
‘মোশন সিকনেস’ ভ্রমণের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। ‘মোশন সিকনেস’ মূলত মস্তিষ্কের এক ধরনের সমস্যা। বিশেষ করে বাস, প্রাইভেটকার বা এ জাতীয় অন্য বাহনগুলোতে এ সমস্যা হয়। শরীরের অন্তঃকর্ণ আমাদের শরীরের গতি ও জড়তার ভারসাম্য রক্ষা করে। যখন গাড়িতে চড়ি তখন অন্তঃকর্ণ মস্তিকে তথ্য পাঠায় যে সে গতিশীল। কিন্তু চোখ বলে ভিন্ন কথা। কারণ তার সামনের বা পাশের মানুষগুলো কিংবা গাড়ির সিটগুলো তো স্থির। চোখ আর অন্তঃকর্ণের এই সমন্বয়হীনতার ফলে তৈরি হয় ‘মোশন সিকনেস’। ‘মোশন সিকনেস’-এ বমির ভাব হয় যার সাথে মাথা ঘোরা, মাথা ধরা প্রভৃতি। মোশন সিকনেস থেকে বাঁচার উপায় হলো, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকুন। বড় বড় শ্বাস নিন। প্রয়োজন হলে চোখ বুজে থাকুন। বই পড়বেন না বা স্থির কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। আদা চিবাতে পারেন। মোশন সিকনেসে কাজে দেবে। ভ্রমণে যাদের বেশি সমস্যা হয়, তারা গাড়িতে ওঠার আধাঘণ্টা আগে ডমপেরিডন জাতীয় ওষুধ খেয়ে নিতে পারেন।
ডিপ ভেইন থ্রম্বসিস
দীর্ঘ ভ্রমণে আরেকটি সমস্যা হলো ‘ডিপ ভেইন থ্রম্বসিস’। অনেকক্ষণ বসে থাকলে শরীরের গভীর অংশের শিরাগুলোতে রক্ত জমাট হয়ে থ্রম্বাস তৈরি হয়। এই থ্রম্বাসগুলো মস্তিষ্কে চলে গেলে স্ট্রোক পযর্ন্ত হতে পারে। তাই র্দীঘ ভ্রমণে একটানা বসে না থেকে একটু হাঁটাচলা করুন। সম্ভব না হলে জায়গায় বসেই হাত পা নাড়ুন। এই সমস্যাটা বয়স্কদের বেশি হয়।
ট্রাভেলার্স ডায়রিয়া
ভ্রমণের খুব প্রচলিত একটি সমস্যা। বেশ কয়েক পদের ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের কারণে এটি হয়। সাধারণত বিভিন্ন ধরনের খাবার যেমন অল্প সিদ্ধ মাংস,সি ফুড, অপাস্তুরিত দুধ এবং দুগ্ধ জাত খাবার, পানি ইত্যাদির মাধ্যমে এটি ছড়ায়। তাই খাবার এবং পানির ব্যাপারে সাবধান থাকুন।
পাহাড়ে ভ্রমণ
বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ম্যালেরিয়া। তাই পার্বত্য এলাকায় ভ্রমণের আগেই প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধক ওষুধ খেয়ে নেওয়া যেতে পারে। প্রযোজনে মশা নিধনকারী স্প্রে বা এরোসল, মশারী ব্যবহার করবেন।
ভ্রমণ যখন আকাশে
আকাশ ভ্রমণে সমস্যা হয় উচ্চতার কারণে। আমরা জানি একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার পরে বাতাসে অক্সিজেনের চাপ কমতে থাকে। মানব শরীরে অক্সিজেনের চাপের সঙ্গে বাতাসের এই অক্সিজেনের চাপের তারত্যম শরীরে নানারকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যেমন : মাথাঘোরা, কানে তালালাগা, বমির ভাব হওয়া। এই সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পেতে পারেন। চুইংগাম চিবানো,ঘনঘন ঢোক গিলা, জুস খাওয়া ইত্যাদি হতে পারে এর সমাধান। তবে যাদের শ্বাস কষ্ট, হার্টের অসুখ, বুকে ব্যথা (এনজাইনা) প্রভৃতি সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো আরো জটিল হতে পারে। ঠান্ডা,সর্দি নাক বন্ধ থাকলে বিমান ভ্রমণ অস্বস্তিকর হতে পারে। বেড়ে যেতে পারে সাইনাসের সংক্রমণ। তাই আগেভাগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শিশুও সুস্থ থাকুক
ভ্রমণে শিশুদের প্রতি বাড়তি যত্নের প্রয়োজন। গরমে অতিরিক্ত ঘাম থেকে ঠান্ডা, সর্দি, শ্বাসনালির ইনফেকশন হতে পারে। বাচ্চাদের এ রকম অসুখ বিসুখ আপনাদের ভ্রমণের আনন্দ মাটি করে দিতে পারে। বাইরের খাবার থেকে সাবধান। প্যারাসিটামল, অ্যান্টিহিসটামিন, নাকের ড্রপ সঙ্গে রাখতে পারেন। ডাক্তার বললে প্রচলিত কিছু অ্যান্টিবায়োটিকও রাখতে পারেন।
ভিন্ন দেশ ভ্রমণে
দেশ ভেদে অসুখ-বিসুখের ধরন ও মাত্রা বিভিন্ন। যে দেশে যাবেন সে দেশের অসুখ বিসুখ সর্ম্পকে আগে থেকেই তথ্য নেবেন। প্রয়োজনে ভ্যাকসিন দিয়ে নেবেন। হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস -বি, টাইফয়েড, চিকেন পক্স, ইয়েলো ফিভার (যে সব দেশে ইয়োলো ফিভারের প্রকোপ রয়েছে সেসব দেশের ক্ষেত্রে) প্রভৃতি ভ্যাকসিন সম্ভব হলে দিয়ে নেবেন। সেসব দেশের আবহাওয়া ও তাপমাত্রা সম্পর্কে আগেভাগে জেনে নেবেন। প্রয়োজনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।
আরো কিছু পরামর্শ
* ভ্রমণে এসিডিটি হতে পারে। আগে থেকেই এসিডিটির ওষুধ সঙ্গে রাখুন।
* উচ্চ রক্তচাপের রোগীরাও বিশেষ সতর্ক থাকবেন। ভ্রমণের দু’একদিন আগে ব্যক্তিগত চিকিৎসকের চেম্বার ঘুরে আসুন।
* ডায়বেটিসের রোগীদের জন্যও একই পরামর্শ। ডায়াবেটিসের রোগীরা ভ্রমণকালীন সঙ্গে গ্লুকোজ গোলানো পানির বোতল রাখুন। সুগার কমে ‘হাইপোগ্লাইসেমিয়া’ হয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়।
* হাতের কাছে বিশুদ্ধ পানির বোতল রাখুন। অনিরাপদ খোলা পানি পান করবেন না।
* বাইরের খাবারের ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। অল্প সিদ্ধ মাংস,অপাস্তুরিত দুধ খাবেন না।
* আপনার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রচলিত কিছু অ্যান্টিবায়েটিকসহ জরুরি কিছু ওষুধ সঙ্গে রাখুন।
* একটা ট্রাভেল কিট বানিয়ে নিতে পারেন, যেখানে থাকবে প্রয়োজনীয় ওষুধসহ, গজ, ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক মলম বা সল্যুশন।
* ভ্রমণের ধরন এবং আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক নির্বাচন করুন। জুতার ক্ষেত্রে বাড়তি মনোযোগ প্রয়োজন। আরামদায়ক কেডস হলে ভালো হয়। মেয়েরা হিল জুতা ব্যবহার না করলেই ভালো।
আপনার ভ্রমণ আনন্দময় হোক। অসুখ যেন ভ্রমণের সুখকে বিঘ্নিত না করে।
লেখক : রেসিডেন্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়