মানসিক সমস্যা নিয়ে যত ভ্রান্তি
মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যা নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। এসব ভ্রান্ত ধারণার জন্য ভুক্তভোগী সঠিক চিকিৎসা পান না বা সামাজিকভাবে অনেক হেয় হতে হয়।
মানসিক সমস্যা নিয়ে সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৩২৬তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : আমাদের সমাজে মানসিক রোগ নিয়ে প্রচলিত কী কী ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে?
উত্তর : অনেকেরই এখন পর্যন্ত ধারণা যে মানসিক রোগ বলে আসলে কিছু নেই। কারণ, প্রত্যেক মানসিক রোগকে আমরা কোনো না কোনোভাবে অন্য ব্যাখ্যার মধ্যে নিয়ে যাই। যেমন ধরুন, সিজোফ্রেনিয়ার মতো রোগগুলোকে আমরা বলি জিনে ধরা বা ভূতে ধরা বা আলগায় পাওয়া। এই অংশটুকু কিন্তু একটি বিশাল অংশ, যারা মানসিক রোগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। এতে তারা রোগটি এড়িয়ে যায়। ভাবে, এ ধরনের রোগ হতেই পারে না। ভাবে, যে এটি কোনো বড় বিষয় নয়। আসলে এটিই একটি বড় বিষয়।
পরে আসে অন্য কুসংস্কারগুলো। যেমন : জিনে ধরা, ভূতে ধরা বিষয়গুলো কুসংস্কার। সবচেয়ে বড় কথা হলো এখন পর্যন্ত আমরা মানসিক রোগকে বলি দুর্বলতা। পারিবারিক দুর্বলতা অথবা একটি ব্যক্তি মানুষের দুর্বলতা। অথবা একটি পরিবারের কোনো একটি ঐতিহাসিক দুর্বলতা। এই জন্য এ রোগগুলো মানুষের কাছে প্রকাশ করতে চায় না। অথবা এটি লজ্জাজনক ব্যাপার। এটা লুকিয়ে রাখা উচিত। এই ধারণাটা অনেকের মধ্যে তৈরি হয়।
প্রশ্ন : আমাদের সমাজে একজন লোক যখন মানসিক সমস্যায় ভোগে, তখন তাকে পাগল হিসেবে ধরা হয়। তার সঙ্গে আত্মীয়স্বজন বা অন্যরা মিশতে চায় না। তারা হয়তো ভাবে, আমার একটি সন্তান সে হয়তো মানসিক সমস্যায় ভুগছে, এটি বললে আমরা হয়তো একঘরে হয়ে যাব। এই ভয় কি কাজ করে?
উত্তর : এটিই। এই ভয়ই কাজ করে। এটিও কিন্তু একটি দুর্বলতার অংশ। দেখা গেল, বিয়ের একটি অনুষ্ঠান আমার ওই মানুষটিকে কখনো সামনে আনি না। অথচ অন্য যেকোনো অসুস্থতা কিন্তু আমরা সামনে নিয়ে আসি। ধরুন, আপনার হার্টের সমস্যা, আপনি কিন্তু সামনে এলে কোনো সমস্যা নেই। আপনার ডায়াবেটিস, সামনে আসতে কোনো সমস্যা নেই। আপনার প্রেশার, সামনে আসতে কোনো সমস্যা নেই। আপনার হাত-পা ভাঙা, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সামান্য পরিমাণ মানসিক সমস্যা এটি বলতেও সমস্যা, ওই ধরনের অবস্থায় পড়তেও সমস্যা। এই যে দুর্বলতা এটি কিন্তু একটি বড় অংশ। যদি এই অংশটুকুকে আমরা পার হয়ে যেতে পারি, তাহলে সারা পৃথিবীতে মানুষের কার্যক্ষমতা বেড়ে যাবে।
একজন মানুষ যখন পরিবারে অসুস্থ হয়, তার যেমন নিজের কার্যক্ষমতা কমে, একই সঙ্গে অন্য একজন দুজন মানুষকে কিন্তু সেখানে যোগ দিতে হয়। তাহলে অর্থনৈতিকভাবেও কিন্তু পরিবার বিভিন্নভাবে বঞ্চিত। শেষ পর্যন্ত কী হয়? ওই কাজটিকে ঘিরে প্রচুর পরিমাণে সমস্যা তৈরি হয়। এ বিষয়গুলো কিন্তু সামনে চলে আসবে। তারা উপার্জনক্ষম হতে পারবে। তারা কাজ করতে পারবে। এ জন্য কুসংস্কার বা স্টিগমা দূর করা খুবই জরুরি।
এটি পরিবার থেকে শুরু করা উচিত। প্রত্যেক মানুষ যদি এইভাবে বোঝে যে এটি একটি অসুস্থতা এবং চিকিৎসা করলে একটি নির্দিষ্ট অবস্থা পর্যন্ত ভালো হয়, তাহলে ভালো হবে।
আরেকটি বিষয় রয়েছে। একে আসলে কুসংস্কার বলব না। তবে এটি একটি সমস্যা। অনেক মানসিক রোগ রয়েছে, যেটি কখনো ভালো না হওয়ার মতো। কিন্তু অন্যান্য অনেক রোগও কিন্তু রয়েছে, যেটি ভালো না হওয়ার মতো। ওইখানে কিন্তু কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা এখানে।
দেখা যায়, যে ওষুধগুলো দেওয়া হয়, এগুলোতে ঘুমের সমস্যা থাকে, অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এগুলোর কারণে কিন্তু স্টিগমা বা বিভিন্ন ধরনের সমস্যা চলে আসে। অনেকে ভাবে, মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে গেলেই ঘুমের ওষুধ দিয়ে দেয়, আর কখনো ভালো হয় না।
প্রশ্ন : কারো কারো আচরণগত সমস্যা হয়, সেটি মানসিক রোগেরই একটি প্রতিফলন হতে পারে। পরিবার বা সমাজের লোক মনে করে এটা কোনো বিষয় নয়, সে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন করছে। এই বিষয়গুলো কীভাবে দূর করা যায়?
উত্তর : এর অনেক বিষয় রয়েছে। কখনো কখনো যে একেবারে ইচ্ছাকৃতভাবে করে না, তা কিন্তু নয়। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের কাছে যদি নিয়ে আসে, আমরা যদি একদিন/ দুদিন বসি তাহলে বুঝি। যেমন : জেলখানার অনেক মানুষ কিন্তু আমাদের কাছে নিয়ে আসে। আমরা কিন্তু বুঝি, কোনটা ইচ্ছা করে করা। আর কোনটা আসলেই অসুস্থ। এটা কিন্তু করে অনেকে। আবার এরপরও যেটি হয়, কিছু কিছু রোগ রয়েছে, আমরা বলি কনভারশন ডিজঅর্ডার বা হিস্টিরিয়া। যে পরিমাণ চাপ নেওয়ার ক্ষমতা থাকে বা দ্রুত যে পরিমাণ ক্ষমতা থাকে ব্যবস্থাপনা করার, যদি কোনো কারণে সমস্যা হয়, তখন কিন্তু তার মধ্যে এক ধরনের লক্ষণ তৈরি হয়। এর আবার একটি সুবিধাও রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর এমনিতেই এই লক্ষণ কমে আসতে পারে। বিষণ্ণতাও কিন্তু কখনো কখনো নিজে নিজেই ঠিক হতে পারে। তখন অনেকের ভুল ধারণা হয়, এ তো ইচ্ছা করে করল, না হলে ভালো হলো কীভাবে।
আবার আরো কিছু কিছু বিষয় রয়েছে। মানুষের ধারণা মানসিক রোগ হলে এটি নিয়মিত হবে। লম্বা সময় ধরে চলতে থাকবে। এটি আর ভালো হবে না। অনেকে মনে করে কোনো রোগ হলে অন্য কোনো কাজই আর করতে পারবে না। আমাদের কাছে বলে, ওর যদি রোগ হয়, তাহলে টাকা চেনে কীভাবে। অনেকে ধারণা করেন, একজন মানুষ যদি মানসিকভাবে অসুস্থ হন, তার কোনো কিছুই আর ঠিক থাকবে না। আবার অনেকে বলে ওর তো মাত্র শুরু হলো। এক মাস ধরে। অনেকে ভাবে, মানসিক রোগ বোধ হয় জন্ম থেকে হবে। এসব কারণে বিষয়গুলো নির্দিষ্টভাবে ধরা যায় না।
প্রশ্ন : একটি দ্বন্দ্ব কিন্তু থেকে যাচ্ছে। এটি দূর করার উপায় কী?
উত্তর : দূর করা তো কঠিন ব্যাপার। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ওই রকম বিশেষজ্ঞ নেই যে সব জায়গায় যাবে। যত বেশি বিশেষজ্ঞরা পৌঁছে গেছে সেইসব জায়গায়, তত সমস্যাগুলো কমে আসছে।
শুরুর দিকে কাজ করার সময় আমরা দেখতাম কি, জিনের আসর বসায় বা নাচানাচি করায়। তারা বলত কি, জিন সারানোর যতটুকু বিষয় সেটি করে দিলাম, কিন্তু এর বাকি যে সমস্যা এর জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। আমাদের কাছে চিঠিও আসত এ রকম। এগুলো কিন্তু এখন কমে আসছে। কিন্তু নেই সেটি আমি বলব না। এর একটি কারণ হলো এর পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি।
প্রশ্ন : অনেকে তো আবার ভালো হয়ে যায়। এর বিষয়টি কী?
উত্তর : কিছু কিছু রোগ রয়েছে সেলফ লিমিটিং বা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকে, এর পর সেরে যায়। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। যেমন : ম্যানিক একটি কন্ডিশন রয়েছে, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার যাদের রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে। এটিই সবচেয়ে বেশি মানুষের চোখে পড়ে। ম্যানিক কন্ডিশনে হয় কী, নিজেকে অনেক বড় মনে করে, অনেক কথাবার্তা বলে, লেকচার দিতে থাকে। আমি ইলেকশন করব, আল্লাহর সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। খাবার খাওয়ার দরকার নেই। ঘুমের দরকার নেই। এই ম্যানিকটাও কিন্তু সেলফ লিমিটিং। দুই মাস থেকে শুরু করে, দুই বছরের মধ্যে এটি ঠিক হয়ে আসবেই। সে নিজে নিজে বুঝতে পারবে না যে কী করছে।
আসলে মানসিক রোগের চিকিৎসার ভ্রান্তি কাটতেই হবে, না হলে সঠিকভাবে এটি ব্যবস্থাপনা করা যাবে না।