কিডনিতে পাথর হয় কীভাবে?

কিডনির পাথর একটি প্রচলিত সমস্যা। অনেকেই এ সমস্যায় ভুগে থাকেন। আজ ৮ নভেম্বর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৯৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান পরামর্শক অধ্যাপক হারুনুর রশীদ।
প্রশ্ন : কিডনিতে পাথর বিষয়টি কী?
উত্তর : আসলে শরীরের জন্য আমরা খাওয়া-দাওয়া করছি। আমরা যে খাবার খাই, সে খাবারের মধ্যে ক্যালসিয়াম, ফসফেট, ইউরিক এসিড, সিস্টিন এগুলো থাকে। এগুলো কিডনির মাধ্যমে পুরোপুরি মেটাবলাইজ (বিপাক) হয় না। না হলে ওই ধরনের লোকদের, যাদের একটু পানি খাওয়ার প্রবণতা কম, তাদের ক্যালসিয়াম, ফসফেট, ইউরিক এসিডের একটি ক্রিস্টিলাইজেশন হয়। এই ক্রিস্টিলাইজেশন হওয়ার কারণে যখন এই জিনিসগুলো রক্ত পরিশোধিত হওয়ার সময় বেরিয়ে যায়, তখন টিবিউলের ভেতর ক্রিস্টালটা গঠন করে ফেলে। এতে ধীরে ধীরে এটি বড় হয়ে, যখন এক সেন্টিমিটার বা আধা সেন্টিমিটার হয়ে যায়, তখন আমরা বলি তার পাথর হয়েছে।
কিছু পারিবারিক রোগ আছে, যাদের বিভিন্ন ধরনের পাথর হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এটাকে বলি মেটাবলিক অস্বাভাবিকতা। এটি শিশুদের ক্ষেত্রে হয়, অল্প বয়স্কদের ক্ষেত্রে হয়। যেটাকে আমরা বলি, সিসটিন স্টোন, অক্সালেট স্টোন। তবে বেশির ভাগ বয়স্কই যে পাথরের সমস্যায় ভোগে, সেটি ক্যালসিয়াম ফসফেট বা ক্যালসিয়াম ইউরিক এসিডজাতীয় পাথর।
প্রশ্ন : পাথর কেন কিডনিতে হচ্ছে? আর পাথর যে হচ্ছে সেটি রোগী কোন উপসর্গের মাধ্যমে বুঝতে পারবে?
উত্তর : এই রোগটি লক্ষণ দিয়ে বোঝা যায়। সে তীব্র ব্যথা অনুভব করে পেছনে, যেখানে কিডনি অবস্থান করে। যদি কিডনির ওপরে পাথর হয়, তবে পাথর যখন একটু নিচে নেমে নলের ভেতর হয়, যাকে আমরা বলি ইউরেটরে আসে, তখন পাথর পেটের নিচের দিকে হয়। এবং এটি রেডিয়েট করতে থাকে। আর ক্ষুদ্র পাথর হলে পাথরের ব্যথাটা বেশি হয়। কোনো কোনো সময় পাথর কিডনির এমন জায়গায় হয়তো থাকে, যেখানে ব্যথা নাও হতে পারে। সেই পাথর আস্তে আস্তে বড় হয়ে যায়। বড় হলে তখন লক্ষণ হতে পারে। আর এর সঙ্গে সঙ্গে যখন ব্যথা হয়, তখন তার প্রস্রাব রক্তবর্ণ হয়ে যায়। লোহিত কণিকা হয়ে যায়। লাল প্রস্রাব হয়ে যায়। এটি ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি লক্ষণ। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে যখন প্রস্রাব বাধা পায়, তখন ঘন ঘন হয়, তবে অল্প পরিমাণে। এই লক্ষণগুলোই সাধারণত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা পাথরের রোগীদের দেখে থাকি।
প্রশ্ন : রোগী আপনাদের কাছে ব্যথা নিয়ে এলে প্রথম পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : আমরা যদি রোগীর ইতিহাস একটু মনোযোগ দিয়ে শুনি, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বুঝতে পারি কোন রোগীর পাথর হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
ওপরের দিকে যদি পাথর হয় ডান দিকে, তখন গল্ডব্লাডারের পাথরের সঙ্গে কিডনির পাথরের কিছু কনফিউশন (দ্বিধা) হতে পারে। তবে নিচের পেটে যখন পাথর হয়, তখন অ্যাপেনডিক্সের ক্ষেত্রে একটু কনফিউশন হতে পারে। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সালপিন জাইটিসের সঙ্গে কনফিউশন হতে পারে। তবে যদি রক্ত যায় পাথরের সঙ্গে, তখন গল্ডব্লাডার হবে না। তখন কিডনিতে পাথর হওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে।
অ্যাপেনডিক্সের কিছু আলাদা লক্ষণ আছে, সেটি হলে সেই লক্ষণগুলো পাব। আর জ্বর গল্ডব্লাডারের পাথর হলেও আসতে পারে, কিডনিতে পাথর হলেও আসতে পারে এবং অ্যাপেনডিক্সের সমস্যা হলেও আসতে পারে।
প্রশ্ন : নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন কি?
উত্তর : সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার উপায় খুব সহজ। আমরা একটা এক্স-রে কেউবি করে ফেলি। এবং তার সঙ্গে একটি আলট্রাসনোগ্রাম করে ফেলি। আলট্রাসনোগ্রাম পাথরের রোগ নির্ণয়ের জন্য ৯৯ ভাগ ভালো ফলাফল দেবে।
প্রশ্ন : রোগীর পাথর হয়ে গেলে চিকিৎসা কীভাবে শুরু করেন?
উত্তর : প্রথমে এর আকারটা দেখে নিই। আকার যদি পয়েন্ট পাঁচ সেন্টিমিটার থেকে এক সেন্টিমিটারের নিচে হয়, আমরা ইউরেটারও দেখে নিই পাশাপাশি। তখন আমরা মনে করি এটি ওষুধ দিয়ে, পানি পান করে বেরিয়ে যাবে।
আর পাথর যদি বেশি হয় এবং আকার বড় হয়, ১ দশমিক ৫ সেন্টিমিটারের ওপরে হয় এবং সেটা যদি কিডনির ওপরের দিকে থাকে, তখন আমরা তাকে ভেঙে নিতে বলি। আর নিচের দিকে যদি পাথর হয়, এটি লিথোট্রিপসি করে আসবে না। একে আপনাকে ছিদ্র করে বের করে নিয়ে আসতে হবে।
তবে সবচেয়ে বড় যে চিকিৎসা একে সার্জিক্যাল করে বের করা হলো, লিথোট্রিপসি দিয়ে গুঁড়া করা হলো বা অন্য কোনো কারণে বেরিয়ে এলো, এর পরও আপনাকে মেডিকেল চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হবে, পাথর যেন পুনরায় না হয়।
পাথর ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ক্ষেত্রে আবার হতে পারে, ছয় মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে। পাথরের অপসারণে তাকে মেডিকেল চিকিৎসায় থাকতে হবে দুই থেকে পাঁচ বছর। এই মেডিকেল চিকিৎসা খুব সহজ। আমরা তার রক্তের ফসফেট, ক্যালসিয়াম, ইউরিক এসিড, সিসটিন ,অক্সালেট পরীক্ষা করে ফেলি। পাথর যদি পাওয়া যায়, তার মেটাবলিক অস্বাভাবিকতা নির্ণয় করে নিই। করে নিয়ে আমরা সাধারণত তাকে তিন ধরনের ওষুধ দিই। এই তিন ধরনের ওষুধ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বলি, কিছু খাবার আপনি পরিহার করবেন। যদি ইউরিক এসিড বেশি থাকে, লাল মাংস এড়িয়ে যেতে বলি। মাছের ডিম এড়িয়ে যেতে বলি। কিছু কিছু শাকসবজি এড়িয়ে যেতে বলি।
আর যদি ক্যালসিয়াম বেশি থাকে, দুধজাতীয় খাবার কম খেতে বলি। যেসব খাবারে ক্যালসিয়াম আছে, সেটি কম খেতে বলি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তাকে পানি বেশি পান করতে বলি। সারা দিন তাকে তিন থেকে চার লিটার পানি খেতে হবে। একটা বদঅভ্যাস আছে মানুষের, সকালবেলা উঠে হয়তো এক লিটার পানি খেয়ে নিল। আর সারা দিন খেল না। এতে কাজ হবে না।
প্রশ্ন : ফলোআপের জন্য আপনারা রোগীকে কয়দিন পর পর আসার পরামর্শ দেন?
উত্তর : সাধারণত আমরা তিন থেকে ছয় মাস পর পর আসতে বলি। ঘন ঘন আসার কোনো প্রয়োজন নেই, পাথর যদি বেরিয়ে যায়। আর যদি বেরিয়ে না গিয়ে কিডনির নিচের দিকে খুব ছোট পাথর থাকে, এক সেন্টিমিটারের নিচে; যদি কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করে, ইউরিনে কোনো অ্যালবুমিন না আসে, আরবিসি না আসে, ডব্লিউবিসি না থাকে, আমরা একে বলি নীরব পাথর। একে ওষুধ দিয়ে সেভাবেই রেখে দিতে পারেন। লিথোট্রিপসি বারবার করা ঠিক নয়। এটি হলে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।