হৃদরোগের কারণেও হতে পারে শ্বাসকষ্ট
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/11/15/photo-1447573137.jpg)
শ্বাসকষ্টের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। হৃদরোগের কারণেও কখনো কখনো শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। তবে বেশির ভাগ লোকই বিষয়টি সম্বন্ধে সঠিকভাবে জানে না। ১৪ নভেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২০৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. শফিউদ্দিন।
প্রশ্ন : শ্বাসকষ্ট বিষয়টি কী এবং এর প্রধান কারণগুলো কী কী হতে পারে?
উত্তর : অধিকাংশ মানুষেরই শ্বাসকষ্টের সমস্যা হতে দেখা যায়। শীতকালে প্রচুর রোগী পাওয়া যায় শ্বাসকষ্টের। অনেক সময় অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে শ্বাসকষ্ট হয়। অনেক সময় দেখা যায়, যে পরিমাণ অক্সিজেনের পরিবহন দরকার, সেটি হচ্ছে না। এটি হলো মূল কারণ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে কারণগুলো এর মধ্যে প্রচলিত এর মধ্যে রয়েছে বঙ্কিয়াল অ্যাজমা। যাকে আমরা সাধারণ ভাষায় হাঁপানি বলি। আমরা সবাই জানি শ্বাসকষ্ট মানে হাঁপানি।
প্রশ্ন : আপনি কি একটু বলবেন কার্ডিয়াক কী কী কারণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে?
উত্তর : আমরা এ রকম প্রচুর রোগী পাই, যারা দীর্ঘদিন ধরে কেবল বঙ্কিয়াল অ্যাজমার চিকিৎসা করিয়েছে। তবে আমাদের কাছে যখন আসে তখন আমরা পরীক্ষা করে দেখি তার মূল কারণ আসলে অন্য জায়গায়। এর মধ্যে খুব প্রচলিত একটি রোগ পাই যেটি হার্টের ভাল্ভের কারণে হয়। যাদের ছোটবেলায় বাতজ্বর থাকে, সেই বাতজ্বর থেকে হার্টের ভাল্ভে সমস্যা হয়। সেখান থেকে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। আবার বেশ কিছু লোক আছে, যাদের জন্মগত হার্টের ত্রুটির কারণে শ্বাসকষ্ট হয়। এ ছাড়া যাদের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়, এরপর যদি কারো সুচিকিৎসা না হওয়ায় একসময় তার হার্টের পাম্প কমে যায়। যাকে আমরা বলি হার্ট ফেইলিউর। হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যায়। তার যে পরিমাণ রক্ত পরিবহন করার কথা, সেটি দিতে পারে না শরীরে। সেই কারণে শরীরে অক্সিজেন কমে যায় এবং সেই কারণে শ্বাসকষ্ট হয়। এটিকে আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলি কার্ডিওমায়োপ্যাথি। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আছে। যেমন ইসকেমিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি। যেটি হার্ট অ্যাটাকের কারণে হয়। বা হার্টের রক্তনালি ব্লক হওয়ার কারণে হয়। আবার কিছু আছে ভাইরাসের কারণে হয়। এগুলো পরবর্তীকালে ডাইলাইটেট কার্ডিওমায়োপ্যাথি হয়। আসলে শ্বাসকষ্টের অনেক কারণ রয়েছে যেটি হৃদরোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেটা আমাদের অনেক রোগীরাই জানে না। তারা মনে করেন, এটি হাঁপানির কারণে হয়েছে।
প্রশ্ন : তাহলে কী কারণে হচ্ছে শ্বাসকষ্ট, সেটি কি অ্যাজমার কারণে না কার্ডিয়াক কোনো কারণে, সেটি বোঝার উপায় রয়েছে কি?urgentPhoto
উত্তর : রোগীর জন্য বোঝাটা কিছুটা কঠিন। যেমন বঙ্কিয়াল অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগ যাকে বলি, এসব রোগের অনেকটাই বংশপরম্পরায় আসে। এই অ্যাজমার সঙ্গে খুব প্রচলিত যেটি থাকে সেটি হচ্ছে কাশি। হাঁপানি রোগের সঙ্গে কাশি থাকে। তবে হার্টের কারণে যেসব শ্বাসকষ্ট হয় সেটাও থাকতে পারে। অ্যাজমায় একটু বেশি থাকে। কাশি থাকবে, জ্বর থাকবে, হাঁচি থাকবে- এগুলো একটু বেশি থাকে। এগুলো অ্যাজমার কারণে হয়। রোগী এখান থেকে কিছুটা অনুমান করতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত যখন রোগী চিকিৎসকের কাছে যাবেন তখন তিনি বের করবেন কোন কারণে তার সমস্যাটি হচ্ছে। তিনি দেখবেন এটা অ্যাজমার কারণে হচ্ছে, না কি হার্টের কারণে হচ্ছে। এরপর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো আছেই। এক্সরে, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম- এ ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টি চিকিৎসকই নির্ণয় করবে। রোগীর পক্ষে বোঝা প্রথমেই কষ্টকর। চিকিৎসকই নির্ণয় করবে কেন সমস্যাটি হচ্ছে।
প্রশ্ন : রোগী কখন আসে আপনাদের কাছে?
উত্তর : আমাদের কাছে রোগীরা তো শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসে। তবে দেখা যায় দীর্ঘদিন ভোগার পর রোগীরা আসে। প্রথম তারা হয়তো বাইরে থেকে কিছু ওষুধ খেল। ভাবল সাধারণ শ্বাসকষ্ট বা ঠান্ডা লেগেছে। আমরা দেখি আমাদের কাছে রোগীরা বেশ শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসে। তখনই আমরা নির্ণয় করি, তার কী কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
প্রশ্ন : এর মানে একজন চিকিৎসকের ওপরও দায়িত্ব বর্তায় একজন রোগীর যখন শ্বাসকষ্ট হওয়ার পর চিকিৎসকের কাছে যান, তখন তার কোথায় যাওয়া উচিত, কী কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে-এসব ব্যাখ্যা করা?
উত্তর : অবশ্যই। আমি বলব, আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রচুর রোগীকে অনেক চিকিৎসক তাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে হোক বা যেকোনো কারণে হোক দীর্ঘদিন ধরে হাঁপানির চিকিৎসা করছেন। আসলে যদি কোনো উন্নতি না হয়, তাদের রেফার করা উচিত। রেফার করলে বিশেষজ্ঞরা বুঝবেন যে সমস্যাটি কি হার্টের ভাল্ভের কারণে হচ্ছে, নাকি অন্য কারণে হচ্ছে। যে কারণেই হোক চিকিৎসা দীর্ঘস্থায়ী। তাই দীর্ঘমেয়াদি ভুল চিকিৎসা হওয়ার থেকে সঠিক চিকিৎসা হওয়া দরকার।
প্রশ্ন : হার্টের এজাতীয় সমস্যা নিয়ে যখন রোগীরা আসছেন তখন কী করেন?
উত্তর : এখানে রোগী থেকে রোগী অবস্থা নির্ভর করে। যদি ভাল্ভের কারণে হয়, তখন তাকে বাতজ্বরের চিকিৎসা করতে হবে। তার ইতিহাস নিয়ে যখন দেখব ছোটবেলায় তার বাতজ্বর ছিল, তার ইকো করে দেখব হার্টের একটি ভাল্ভ চেপে গেছে, অথবা তার ভাল্ভ লিক করছে, তখন আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে তাকে ওষুধ দিয়ে ঠিক করব। এসব রোগীর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাতে-পায়ে পানি চলে আসে। পানি কমানোর জন্য ওষুধ দেব। এরপর মূল কারণ তো দেখতেই হবে। যদি তার একটি মায়োটিক ভাল্ভ নষ্ট হয়ে যায়, এটিকে সার্জারি করে বা সার্জারি ছাড়াও ঠিক করা যায়। কৃত্রিম ভাল্ভ লাগিয়ে দেওয়া যায়।
প্রশ্ন : কোথায় করা হচ্ছে এই চিকিৎসাগুলো?
উত্তর : বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে, বিশেষ করে ঢাকায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তো নিয়মিত হচ্ছে। এ ছাড়া জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল আছে সেখানে হচ্ছে।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন রিউমেটিক ফিবার থেকে ভাল্ভের সমস্যা হতে পারে। আসলে এটি থেকে কীভাবে হৃদরোগের আশঙ্কা হতে পারে?
উত্তর : রিউমেটিক ফিবার আসলে অল্প বয়সের রোগ। এটা পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়সে কারো কারো শুরু হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ১৯ বয়সের মধ্যে বেশি হয় বাতজ্বরটি। একধরনের জীবাণু রয়েছে এর মাধ্যমে সেটি হয়। অনেকের দেখবেন ছোটবেলায় গলা ব্যথা হচ্ছে, টনসিল হচ্ছে, তবে এটিকে এড়িয়ে যাচ্ছে। ওই জীবাণুর মাধ্যমে যখন সংক্রমণ বারবার হয়, তখন তার একটি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এটি তখন হার্টের ভাল্ভের সঙ্গে মিল থাকার কারণে সেখানেও আক্রান্ত করে ফেলে। সেখানে অ্যাটাক করলে তখন ভাল্ভের সমস্যা হয়। বয়ঃসন্ধিকালে যখন সমস্যাটি হয়, তখন দেখা যায় কারো কারো গিরা ফুলে যাচ্ছে, ব্যথা হয়। পাশাপাশি জ্বর থাকে। এরপর বুক ধড়ফড়, বুক ব্যথার সমস্যাও হয় অনেক সময়। এরপর কারো কারো ত্বকে কিছু সমস্যা হয়।
প্রশ্ন : এই সমস্যাগুলোর যদি চিকিৎসা করা না হয় তাহলে কি জটিলতা হিসেবে হার্টের সমস্যা হয়?
উত্তর : এর চিকিৎসা না করলে যে সবারই সমস্যা হবে সেটি নয়। তবে যত বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ আছে সবারই ওই ইতিহাস আছে। নীরব রিউমাটিক ফিবার বলেও একটি বিষয় রয়েছে। তার যে কোনো সময় রিউমেটিক ফিবার হয়েছিল, রোগী হয়তো জানেই না। তবে এটি সঠিক যে, কোনো না কোনো সময় রোগীর বাতজ্বর ছিল। সেটা রোগী বুঝতে পারেনি। আর ৫০ ভাগ রোগী ইতিহাসে বলে তার সমস্যা হয়েছিল।
প্রশ্ন : তাহলে রোগীদের প্রতি আপনাদের পরামর্শ কী থাকবে এই জাতীয় জটিলতার দিকে রোগী যেন যেতে না পারে?
উত্তর : বাতজ্বরজনিত হৃদরোগের কথা বলি, তাহলে বলতে হবে ছোটবেলায় যাদের বারবার গলা ব্যথা হয় বা টনসিলের সমস্যা হয়, তখন বাবা-মায়ের উচিত তাকে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করানো। বিশেষ করে ঠান্ডা খাবার বেশি না খাওয়া। এগুলোতে যদি সতর্ক থাকে তাহলে এ জাতীয় আক্রমণের আশঙ্কা কম। এটা যদি বাতজ্বরজনিত শ্বাসকষ্ট হয় তার বেলায়। আর অন্য কারণে যেগুলো বললাম, হার্টের রক্তনালি ব্লক হয়ে যদি হার্ট ফেইলিউর হয়, সেই শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধের জন্য হার্টের ব্লকের চিকিৎসা করতে হবে। তাদের ওষুধের পাশাপাশি হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে এনজিওগ্রাম করতে হবে। এনজিওপ্লাস্টি করতে হবে। তাহলে পরবর্তীকালে তার হার্টের পাম্প ঠিক থাকবে। এতে আর শ্বাসকষ্ট হবে না।
প্রশ্ন : এনজিওগ্রাম করতে গেলে অনেকে ভয় পায়। ভয় যাতে না পায় সেই বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী হবে?
উত্তর : এনজিওগ্রাম ভীতি একসময় ছিল। তবে এখন ভয় আছে বলে আমি মনে করি না। এনজিওগ্রাম অস্ত্রোপচার বা কোনো কাটা-ছেঁড়া করতে হয় না। কেবল হার্টের রক্তনালিতে ডাই দিয়ে দেখি সেখানে কোনো ব্লক আছে কি না। হার্টের রক্তনালিতে তো সরাসরি পৌঁছানো যায় না, সে জন্য পায়ের বা হাতের রক্তনালিতে লোকাল এনেসথেসিয়া দিই। এটি দিয়ে একটি চিকন ক্যাথেডার পাস করে ডাই দিয়ে রেকর্ড করে দেখি কোথায় কোথায় ব্লক আছে। এটা কেবল লোকাল এনেসথেসিয়া। কোনো কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন পড়ে না এবং রোগীর জ্ঞানও থাকে। এটি ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে হয়ে যায়।