চোখের গ্লুকোমার চিকিৎসা কী?

চোখের বেশ জটিল একটি রোগের নাম গ্লুকোমা। তবে এর এখন অনেক আধুনিক চিকিৎসা আমাদের দেশে করা হচ্ছে। আজ ১৮ নভেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২০৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ গ্লুকোমা সোসাইটির প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ আই হাসপাতালের ফ্যাকো ও গ্লুকোমা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম নজরুল ইসলাম।
প্রশ্ন : গ্লুকোমা চোখের অত্যন্ত জটিল একটি রোগ। একে বলা হয় তুষের আগুন বা সাইলেন্ট কিলার। এটি নীরবে নীরবে চোখকে অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যায়। গ্লুকোমা রোগটি কী? এবং এতে কী ঘটে?
উত্তর : গ্লুকোমা চোখের একটি রোগ। যেখানে মানুষ নীরবে অন্ধত্ববরণ করে। কেন হয়? চোখের একটি স্বাভাবিক চাপ রয়েছে, যেটি ১০ থেকে ২০ মিলিমিটার মার্কারি। সাধারণত এর চাপ যদি কারো বেড়ে যায়, তাহলে চোখের ভেতর যে অবকাঠামো থাকে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন মানুষের দৃষ্টির পরিসীমা কমতে শুরু করে। দৃষ্টির পরিসীমা কমতে কমতে একটি সময় আসে, যখন তিনি আর দেখতে পান না। এই অবস্থাটি হলো চোখের রোগ গ্লুকোমা।
প্রশ্ন : এতে মানুষ দেখতে পায় না কেন? কী ক্ষতি হয়?
উত্তর : যখন একটি আলো চোখের ভেতর ঢোকে, তখন চোখের ভেতর একটি স্নায়ু কোষ, গ্যাংলিয়ন কোষের মধ্যে গিয়ে উদ্দীপিত হয়। চোখের চাপ বেড়ে গেলে গ্যাংলিয়ন কোষটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন তার দেখার ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং শেষ পর্যন্ত দেখার পরিসীমা কমে যায়। একটি মানুষের চোখে প্রায় ১২ লাখ গ্যাংলিয়ন কোষ রয়েছে, তার চোখের চাপ বাড়ার কারণে ছয় লাখ গ্যাংলিয়ন কোষ নষ্ট হয়ে গেল। তখন তার অর্ধেক দৃষ্টির সীমা কমে যাবে। আর আরো যদি ছয় লাখ কমে যায়, তখন তিনি পুরোটাই অন্ধ হয়ে যাবেন। এই জন্য গ্লুকোমায় সোজাসুজি দেখাটা শেষ পর্যন্ত থাকে। তবে পাশের দেখা সীমাটা কমে যায়। মূলত এটি স্নায়ুর ক্ষতি করে। এবং এটি ঠিক হয় না এমনভাবে ক্ষতি করে। আপনি প্রথমে বলেছিলেন এটি জটিল রোগ। চোখের ছানি যেমন অস্ত্রোপচার করলাম, পরদিন উনি ১০০ ভাগ সম্পূর্ণ দেখতে পারেন। গ্লুকোমাতে ওনার যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, সেটি ঠিক করা যায় না। ওনার ওই অংশটুকু আর ফেরত আসবে না। যতটুকু রয়েছে সেটাকেই বিদ্যমান রাখার জন্য চিকিৎসা করতে হবে।
প্রশ্ন : চোখের ছানি এবং গ্লুকোমা রোগের পার্থক্য কী? ব্যক্তি কী করে বুঝবে সে গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত?
উত্তর : আমি মনে করি এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। কারণ সাধারণ মানুষ গ্লুকোমায় আক্রান্ত হয়ে অন্ধত্ব বা ছানিতে আক্রান্ত হয়ে অন্ধত্ব বুঝতে পারবেন না। কারণ ছানিতে উপসর্গ থাকে না। গ্লুকোমাতেও উপসর্গ থাকে না। সে জন্য যেকোনো কারণে যদি উনি চোখে না দেখেন তাহলে উচিত হবে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে জেনে নেওয়া যে ছানি পড়েছে, না কি গ্লুকোমা হয়েছে। এটিই একমাত্র সঠিক পথ। নিজের পক্ষে বোঝা আসলে কঠিন।
প্রশ্ন : গ্লুকোমার রোগীর কি দেখার ক্ষেত্রটা ঝাপসা হয়, না কি সীমা (ফিল্ড) ছোট হয়ে আসে?
উত্তর : ছানি হলে তার সম্পূর্ণ দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। আর গ্লুকোমাতে সাধারণত মানুষের ঝাপসা হয় শেষ পর্যায়ে। তার দেখার ক্ষেত্রটা ছোট হয়ে যায়। প্রথম দিকে কেবল দৃষ্টির পরিসীমাটা কমতে থাকে। উনি বুঝতে পারেন না, দৃষ্টি কমে যাচ্ছে। যখন দৃষ্টি অনেক কমে গেছে তখন বলে, আমি তো দেখতে পারছি না। এদিক সেদিক দেখতে পারছি না। চলতে ফিরতে দুর্ঘটনা ঘটছে তখন তিনি বুঝতে পারেন কিছু সমস্যা হচ্ছে। তখন উনি চিকিৎসকের কাছে আসেন।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন ইরিভারসেবল ডেমেজ। অর্থাৎ যে ক্ষত বা ক্ষতি হয়ে যায়, সেটি আর পূরণ হওয়ার নয়। সে জন্য যখন তার দৃষ্টিশক্তি কমে গেল সেটাকে আর বাড়ানো সম্ভব নয়। সে জন্য কি আগেভাগে কোনো চেক আপ করানো যায়? এই রোগে কারা ঝুঁকিপূর্ণ? তাদের আগেভাগে কি চেকআপ করা যায়?
উত্তর : গ্লুকোমা রোগটি সাধারণত হয় ৩৫ বছরের পর হয়। ছেলেমেয়ে সবারই হয়। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের সংখ্যাটা বেশি। যাদের মায়োপিক চশমা রয়েছে তাদের হতে পারে। আবার যারা প্লাস পাওয়ার পরেন, তাদেরও একধরনের গ্লুকোমা হতে পারে। আর যাদের সাধারণত গ্লুকোমা রয়েছে তাদের বংশাণুক্রমে ছেলেমেয়ে, ভাই বোনের গ্লুকোমা হতে পারে। এগুলো ঝুঁকির কারণ। যাদের এ রকম আশঙ্কা রয়েছে তাদের বছরে একবার চোখ দেখানো উচিত। চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নেওয়া উচিত তার গ্লুকোমা আছে কি নেই। যাদের বয়স চল্লিশের বেশি, তাদের চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত চেকআপে যাওয়া উচিত।
প্রশ্ন : আগেভাগে রোগ নির্ণয় করলে লাভ কী ?
উত্তর : আমি একটি উদাহরণ দিই। একটি রোগী হয়তো আমার কাছে আসলেন, তাঁর চোখের ভেতর আমি পরীক্ষা করে দেখলাম প্রাথমিক গ্লুকোমা হয়েছে। তাঁর স্নায়ুক্ষতি মাত্র ৩০ ভাগ হয়েছে। ৭০ ভাগ দৃষ্টি ভালো আছে। তাহলে আমি যখন চিকিৎসা করলাম তাঁর ৭০ ভাগ দৃষ্টিশক্তি সারা জীবন ভালো থাকবে। যদি তাঁর চিকিৎসা ঠিকমতো হয়, আর কমবে না। তবে উনি যদি আমার কাছে আসেন ৯০ ভাগ দৃষ্টি ক্ষতি করে, তাহলে আমার পক্ষে ওই ৯০ ভাগ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে ওই ১০ ভাগ সারাজীবন রক্ষা করা সম্ভব। তাই আগেভাগে রোগ নির্ণয় করা গ্লুকোমার প্রতিরোধক। যত তাড়াতাড়ি আসবেন তত দ্রুত তিনি নিজের দৃষ্টিশক্তিকে রক্ষা করবেন। এ জন্য আমাদের সমাজের একটি কাজ হলো মানুষকে সচেতন করা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আমরা চেষ্টা করি আমাদের রোগীরা যেন সচেতন হন, যে তাঁর গ্লুকোমা থাকতে পারে, তবে উনি যেন প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণিত হন। এটা আমাদের উদ্দেশ্য।
প্রশ্ন : আপনি গ্লুকোমা সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। আপনারা কি সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কোনো উদ্যোগ নিয়ে থাকেন?
উত্তর : প্রথম হলো আমরা বছরে একবার বিশ্ব গ্লুকোমা দিবস পালন করি। বিশ্ব গ্লুকোমা সপ্তাহ করি। সারা বিশ্বের সঙ্গে আমরা মিলিয়ে সেটা করি। এই সময়ে আমরা নানা রকম কর্মসূচি করি। এর মধ্যে একটি হলো রেডিও, টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করা। খবরের কাগজে প্রবন্ধ দেওয়া। লিফলেট ছেপে বিভিন্ন মানুষের কাছে দিই, ব্যানার করি। সিম্পোজিয়াম করি, সেখানে সাংবাদিক ভাইদের আমন্ত্রণ জানাই। এভাবে আমরা মানুষকে জানানোর চেষ্টা করি। আর সারা বছর আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলায় যাই, সেখানে গ্লুকোমার ওপরে সেমিনার করি। চিকিৎসকদের জ্ঞান বাড়ানোর জন্য আমরা সেমিনার করছি।
প্রশ্ন : এগুলো ভালো উদ্যোগ। এবার গ্লুকোমার চিকিৎসা সম্বন্ধে একটু বলেন?
উত্তর : আমাদের ধারণা হলো গ্লুকোমা হলে হয়তো চোখটা অন্ধ হয়ে গেল। আমি মনে করি এই ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। কারণ গ্লুকোমা যেই পর্যায়ে নির্ণয় হোক না কেন সেখান থেকে তার আধুনিক চিকিৎসা সম্ভব। এবং এটি বাংলাদেশে। আমার কাছে অনেক রোগী আসেন যার ৯৯ শতাংশ স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। অনেক চিকিৎসক এর চিকিৎসা করতে ভয় পান। ভাবেন, আমরা যদি এর অস্ত্রোপচার করতে চাই, দৃষ্টি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এটা সত্য। তবে আমরা যদি কিছু না করি, তবে ১ ভাগও চলে যাবে। ব্যক্তি অন্ধ হয়ে যাবেন। তার থেকে ঝুঁকি নেওয়া অনেক ভালো। এর চিকিৎসা আমাদের দেশে আছে। গ্লুকোমার চিকিৎসা তিন রকম। একটি হলো চোখের ফোঁটা ওষুধ বা মেডিকেল চিকিৎসা। দ্বিতীয় হলো, লেজার চিকিৎসা। তৃতীয় হলো শল্যচিকিৎসা বা সার্জিক্যাল চিকিৎসা। এই তিনটি আধুনিক চিকিৎসাই আমাদের দেশে বিদ্যমান।
প্রশ্ন : কোন পর্যায়ে এলে কখন, কোন চিকিৎসা করতে হয়?
উত্তর : যদি প্রাথমিক অবস্থায় রোগী পাই, তাহলে চেষ্টা করব, একটি ওষুধ দিয়ে তার চোখের চাপ কমিয়ে নিরাপদ মাত্রায় রাখতে। যদি দেখি ওনার চাপ কমছে না, বেড়ে যাচ্ছে, চোখের ভেতরের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাহলে আমরা দ্বিতীয় ওষুধ যোগ করব। সেটা সফল না হলে তৃতীয় ওষুধ দিই। এটিতেও না হলে বলব, আপনি লেজার চিকিৎসা করেন। লেজার দিলেও কিছুটা কাজ হয়। তাতেও যদি না হয়, তবে সার্জারি করতে হয়। এটা আমরা করব। শল্যচিকিৎসার মধ্যে ১০০ রকমের চিকিৎসা রয়েছে।
প্রশ্ন : প্রচলিত শল্যচিকিৎসা কী কী?
উত্তর : একটি চিকিৎসা প্রচলিত। সেটি হলো, ট্রাবেকুলেকটোমি। এটি একটি বাইপাস সার্জারি। আপনি জানেন, হার্টে যখন ব্লক হয় আমরা বাইপাস সার্জারি করি। আপনি জানেন গ্লুকোমা কেন হয়? চোখের ভেতর একটি তরল পদার্থ তৈরি হয়, এটা বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে চোখের চাপ বাড়তে শুরু করে। আমরা আলাদা একটি বাইপাস করে দিচ্ছি যাতে করে তরলটি বেরিয়ে যেতে পারে। বেরিয়ে গিয়ে আবার রক্তের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এতে চোখের ভেতরে চাপ কমে যাচ্ছে। এই অস্ত্রোপচারটির নাম ট্রাবেকুলেকটোমি। এটি সারা বিশ্বে গ্লুকোমার চিকিৎসায় ৯৫ শতাংশ। যেটা আমাদের দেশে বেশিরভাগ চিকিৎসকরা করতে পারেন। আর বাকি যে আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে, যেমন যদি ট্রাবেকুলেকটোমি ফেল করে, বা আরো জটিল অবস্থা হয়, তখন আমরা চোখের পাশে ভাল্ভ প্রতিস্থাপন করি। এটি আমরা বাংলাদেশে করছি। এর সফলতা অনেক বেশি। তবে কিছু গ্লুকোমা চিকিৎসা রয়েছে যেটাতে ‘ইমপ্লেন্ট’ করতে হয়, সেটি আমরা এখনও করতে পারি নাই। কারণ ‘ইমপ্লেন্ট’গুলো অনেক ব্যয়বহুল। তবে আমরা আশা করছি এটা করতে পারব।