সঞ্জীবনী
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়
দেশের জনগণকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া এবং দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতেই অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের থেকে একটু ভিন্নতা অনুভব হলো। লাল ইটের ভবনটির ভেতর বেশ পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। জানা গেল, কয়েক মাস ধরে এই বিষয়টি হয়েছে। নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে হাসপাতালটিকে। দেশের একটি আধুনিক মানের মডেল হাসপাতাল গড়ার লক্ষ্যে স্বপ্ন দেখছেন এখানকার চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিতরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বর্তমানে সান্ধ্যকালীন চিকিৎসাসেবাও দিয়ে থাকেন।
চলুন জানা যাক এই হাসপাতালের শুরুর কথা এবং বর্তমানে মডেল হাসপাতাল হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
শুরুর কথা
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালটির পাকিস্তান আমলে নাম ছিল আইয়ুব সেন্ট্রাল হাসপাতাল। এটি পরবর্তীকালে ৩৭৫ শয্যাবিশিষ্ট শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল নামে রূপান্তরিত হয়। পর্যায়ক্রমে এটি বর্তমানে ৮৫০ শয্যার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়েছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ডিজাইন করেছেন বিশ্ববিখ্যাত লুই আই কান। ১৯৬৩ সালে ২০০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণের একটি প্রকল্প ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলে পাস হয়। ১৯৬৪ সাল থেকে এখানে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান শুরু হয়। ১৯ দশমিক ৮ একর জমির ওপর দোতলা ভবনে বহির্বিভাগ সেবার মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু। পাশাপাশি প্যাথলজি, রেডিওলজি ও পাঁচটি শয্যার সমন্বয়ে ইনডোর সার্ভিস চালু হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই তা ২৫ শয্যায় উন্নীত হয়।
১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীনের পর বিখ্যাত আমেরিকান সার্জন প্রফেসর ডা. রোন্যাল্ডি গ্রাস্ট বাংলাদেশে আসেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার্থে ক্যাম্প পরিচালনা করা হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নাম পরিবর্তন করে উপমহাদেশের বিশিষ্ট নেতা ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র নামে পরিচিত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে এর নামকরণ করেন এবং ৭৫ শয্যায় উন্নীত করেন।
১৯৮৩ সালে তিন বছরের মধ্যে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল করার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে ৩০০ শয্যায় উন্নীত হয় এবং পরবর্তীকালে সরকার ও আইওসির একটি চুক্তির মাধ্যমে ৩৭৫ শয্যায় উন্নীত হয়। পাশাপাশি প্যাথলজি, রেডিওলজি, ক্যাজুয়ালিটি বিভাগসহ একটি জেনারেল হাসপাতালের সার্বিক সার্ভিস শুরু হয়।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট তৃতীয় তলা ভবনের উদ্বোধন করেন। এই সময়ে হাসপাতালটিতে সব ধরনের মেডিকেল সার্ভিস চালু হয়।
সাবেক পরিচালক প্রফেসর কাজী শহীদুল আলম ও বর্তমান পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়ার নেতৃত্বে মেডিকেল কলেজ তৈরির প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তরের উদ্যোগ নেন। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার একে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সরকার পরিবর্তনের পর ৬ মে ২০০৬ সালে ১০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া মেডিকেল কলেজ হিসেবে এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীকালে ১ জুলাই ২০০৯ এটি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নামেই ফিরে যায়। ২০০৯ সালে এখানে ডেন্টাল ইউনিট চালু হয়। ২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসপাতালসংলগ্ন ছয়তলা মেডিকেলের উদ্বোধন করেন।
সেবা
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট ৩৫টি বিভাগ রয়েছে। মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ছাড়াও আছে শিশু, নাক-কান-গলা, অর্থোপেডিকস, নিউরোসার্জারি, কার্ডিওলজি, নিউরো মেডিসিন, শিশু সার্জারি, বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি, সাইকিয়াট্রি, গ্যাস্ট্রো-এনটেরোলজি, হেপাটোলজি ইত্যাদি বিভাগ। এ ছাড়া আছে অন্তর্বিভাগ, বহির্বিভাগ, জরুরি ও ক্যাজুয়ালটি বিভাগ।
আউটডোরে শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া অন্যান্য দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বহির্বিভাগে চিকিৎসকরা চিকিৎসা দেন। বহির্বিভাগে প্রতিদিন একজন বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট রেফার্ডকৃত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন।
২৫০ থেকে ৩০০ জন রোগীর জরুরি বিভাগে এবং ২০০০ থেকে ২৫০০ রোগীর বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ১৬০ জনের বেশি রোগীকে ভর্তি করা হয়।
এছাড়া প্যাথলজি বিভাগের প্রায় সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সরকারি নিয়ম মেনে করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও দুস্থ রোগীদের জন্য অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিনামূল্যে করা হয়।
বর্তমানে চিকিৎসকের সংখ্যা ১৬৫ জন। এ ছাড়া সার্বক্ষণিক ১০৩ জন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ও ২১৬ জন অবৈতনিক চিকিৎসক কর্মরত আছেন।
পুরুষ ওয়ার্ডে আবুল কাসেম হেপাটাইটিস সি নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। জানালেন, এখানে চিকিৎসা বেশ ভালো হচ্ছে এখন। চিকিৎসকদের ব্যবহারও বেশ ভালো। হাসপাতালটি বর্তমানে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। এটা খুব স্বস্তিদায়ক।
সিরাজুল ইসলাম (৬০)। গাজীপুর থেকে এসেছেন। সাতদিন আগে ভর্তি হয়েছেন। কিডনিতে সমস্যা। বললেন, এখানে চিকিৎসা খারাপ নয়। সন্ধ্যায় চিকিৎসকরা এসে দেখে যান।
মডেল হাসপাতাল করার লক্ষ্যে
হাসপাতালের অবস্থা নিয়ে কথা হয় বর্তমান পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতালকে বাংলাদেশের একটি মডেল হাসপাতাল হিসেবে পরিণত করতে চাই। এ জন্য আমার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে আছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, যার প্রায় ৮০ ভাগ সফল হওয়া গেছে। এ ছাড়া চিকিৎসকদের সময়ানুবর্তিতা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সান্ধ্যকালীন রাউন্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা আগে ছিল না। এ ছাড়া সচেতনতা বাড়াতে এখানে রোগীদের সার্বিক দিকনির্দেশনা ও দালালমুক্ত হাসপাতাল গড়ার লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক মাইকিং করা হয়।’
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে আছে ছয়তলা করার পরিকল্পনা। বর্তমানে আছে তিনতলা। এ ছাড়া শিক্ষানবিশ, চিকিৎসক ও সেবিকাদের হোস্টেল নির্মাণ করা। নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেন্টার তৈরি করা। এছাড়া মর্গ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে।
ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘মডেল হাসপাতাল করতে গেলে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এর জন্য কাজ করছি। এর মধ্যে কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট কেয়ারের জন্য ৪৩টি কমিটি করেছি। যেখানে ডাক্তার, নার্স, ক্লিনাররাও অন্তর্ভুক্ত। এঁদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।
‘অনেকগুলো কমিটি করেছি। এর মধ্যে রয়েছে সার্জিক্যাল অডিট কমিটি, ডেথ রিভিউ কমিটি, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কমিটি, জীবাণুমুক্তকরণ কমিটি ইত্যাদি। অনেকগুলোরই কাজ শুরু হয়ে গেছে। কোনো ভুল চিকিৎসা করা হচ্ছে কি না তাও দেখা হচ্ছে।
‘প্রতি মাসে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করা হয়। প্রণোদনা কমিটি করা হয়েছে। প্রতি মাসে যে সেরা কাজ করছে তাকে সার্টিফিকেট ও আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা হবে। এভাবে আমরা হাসপাতালটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করছি। আশা করছি আমরা সাফল্য পাব।’