ডায়াবেটিসে কিডনি রোগ হলে কী করবেন?
ডায়াবেটিস হলে শরীরে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গতেই এর প্রভাব পড়ে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে কিডনির রোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যায়।
আজ ১৮ জানুয়ারি এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩০১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিমুদ্দিন। বর্তমানে তিনি ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও বারডেমের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : আমরা জানি, ডায়াবেটিস হলে আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ধীরে ধীরে তার কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। এই বিষয়ে একটু বলবেন?
উত্তর : আসলে ডায়াবেটিস তো নিজে কোনো অসুখ নয়। আপনার রক্তে ডায়াবেটিস থাকলে টেরও পাবেন না কিছু। কিন্তু যখন জটিলতা হবে তখন বুঝতে পারবেন এটি আসলেই একটি রোগ। ডায়াবেটিসের জটিলতাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করি। একটি হলো, মাইক্রোভাসকুলার কমপ্লিকেশন। আরেকটি হলো ম্যাক্রোভাসকুলার কমপ্লিকেশন। এটি জানলে বোঝার জন্য সুবিধা হয়।
কিডনি রোগ হলো মাইক্রোভাসকুলার কমপ্লিকেশন। মাইক্রোভাসকুলার শুধু কিডনিতে হবে না। অন্য জায়গাগুলোতে হবে। যার কিডনির রোগ হয়েছে তার স্নায়ুর রোগ হবে। তার চোখের রোগ হবে। এই তিনটি মিলে হলো মাইক্রোভাসকুলার কমপ্লিকেশন।
কিডনিতে দুই ধরনের সমস্যা হয়। আমরা এক সঙ্গে বলি ন্যাফ্রোপ্যাথি। কিডনি থেকে প্রোটিন যায়, প্রোটিনিউরিয়া বলে। আরেকটি হলো রেনাল ফেইলিউর। কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এখন প্রোটিনিউরিয়ার কতগুলো পর্যায় আছে। একটি হলো মাইক্রো অ্যালবুমিনিউরিয়া। আরেকটি হলো ক্লিনিক্যাল প্রোটিনিউরিয়া। আর নেফ্রোটিক রেঞ্জিপ্রোটিনিউরিয়া। কিডনি দিয়ে সাধারণত কিন্তু প্রোটিন যায় না। কিডনির যে ছাঁকনি আছে ওই ছাঁকনি দিয়ে সবকিছু বের হয় না। কিছু কিছু জিনিস বেরিয়ে যায়। আর কিছু কিছু ভেতরে আসে। সেগুলো শরীরে দরকার সেগুলো উপকারী। এর মধ্যে প্রোটিন উপকারী।
কিডনির ছাঁকনিতে যখন সমস্যা হয়, অসুস্থ হয় তখন সমস্যা হয়। এর একটি কারণ হলো ডায়াবেটিস মেলাইটাস। তখন প্রোটিন যায়। একে বলে প্রোটিনিউরিয়া। ৩০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম যখন ২৪ ঘণ্টায় যায় তখন একে বলে মাইক্রো অ্যালবুমিনিউরিয়া। তিনশর বেশি হলে একে বলে ক্লিনিক্যাল প্রোটিনিউরিয়া। আর তিন হাজার মিলিগ্রাম যখন যায়, তখন একে বলে নেফ্রোটিক সিনড্রোম।
প্রশ্ন : আমাদের কিডনি ডায়াবেটিসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিষয়টি আমরা বুঝব কীভাবে?
উত্তর : যার ডায়াবেটিস আছে তাকে আমরা পরামর্শ দেই কীভাবে রুটিন পরীক্ষা করতে হয়। যার ডায়াবেটিস রয়েছে সে রক্তের সুগার পরীক্ষা করে। যার ট্যাবলেট লাগে না, শুধু ব্যায়াম করে, তার সবসময় পরীক্ষা না করলেও হয়। তবে যার ট্যাবলেট লাগে, তার পরীক্ষা করা লাগে। কারণ, হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে ঝামেলা হয়। তাই হাইপোগ্লাইসেমিয়া ঠিক করার জন্য পরীক্ষা করে দেখতে হয়। আর যে ইনসুলিন নেয় তার নিয়মিত পরীক্ষা করতে হয়। আর যারা ইনসুলিন নেয় তাদের তিনবার পরীক্ষা করতে হয়। যদিও বাস্তবিকভাবে এটা অনেকে করেন না। তবে করা উচিত। আর যার ট্যাবলেট লাগে সে ইচ্ছে মতো করতে পারে।
আমরা সাধারণত বলি যার ইনসুলিন লাগে সে দিনে যতবার লাগে বাসায় পরীক্ষা করবে। তবে মাসে অন্তত একবার ডায়াবেটিস রোগীদের ল্যাবরেটরিতে গিয়ে সুগার টেস্ট করা উচিত। ঠিক একইভাবে গ্লুকোজ কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেটা বোঝার জন্য তিন মাসে একবার যদি হিমোগ্লোবিন এ-ওয়ান-সি পরীক্ষাটি করে তাহলে তার অবস্থাটা বোঝা যায়।
এখন কিডনি দেখতে হবে। কিডনি দেখতে হলে সবারই আসলে ইউরিনের অ্যালবুমিন পরীক্ষা করা উচিত। আজকাল মাইক্রো অ্যালবুমিনের রুটিন করা হয়েছে। তবে মাইক্রো অ্যালবুমিন খুব সহজ না। মাইক্রো অ্যালবুমিন জানতে বিশেষ পরীক্ষা লাগে। এটি সব গবেষণাগারে সবসময় করা যায় না। সেই জন্য রুটিন অ্যালবুমিন পরীক্ষা করতে হয়। রুটিন অ্যালবুমিন পরীক্ষা করা সহজ। এখন অ্যালবুমিন থাকা মানেই্ যে অসুখ হয়ে গেল, বিষয়টি তা নয়। কিছু অবস্থা রয়েছে যেখানে এমনিতেই অ্যালবুমিন যায়। সেইগুলো বাদ দিয়ে যদি থাকে, বা পরপর তিনবার পরীক্ষা করে যদি প্রস্রাবে অ্যালবুমিন থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তার সমস্যা আছে। তার আগেও যদি আমরা কেউ পরীক্ষা করতে চাই, তাহলে মাইক্রোঅ্যালবুমিন করে দেখতে হবে। মাইক্রোঅ্যালবুমিন কেবল ন্যাফ্রোপ্যাথির জন্য নয়। হৃদপিণ্ডের রোগ, মস্তিস্কের রোগেও নির্দেশক।
এখন আমরা বুঝব কী করে যে কিডনির অসুবিধা হচ্ছে? যারা সাধারণ লোক আছি, যদি চোখ একটু ফুলে, পা একটু ফুলে ধরে নেয় আমার কিডনির রোগ আছে। একে বলা হয় ইডিমা। আবার অনেকে মনে করে পিছনে ব্যথা, বোধ হয় কিডনির অসুবিধা হয়ে গেছে। কিডনির যে অসুখকে আমরা ভয় পাই, এটাতে কোনো দিন ব্যথা হয় না। রেনাল ফেইলিউরে (কিডনি অকার্যকর) কোনো দিন পিছনে ব্যথা হয় না। ডায়াবেটিসে রেনাল ফেলিউর হয়।
তবে কিডনিতে যদি সংক্রমণ হয় বা পাথর হয়, তাহলে কিন্তু ব্যথা হতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীর কিডনির সংক্রমণ বেশি হতে থাকে। তবে ডায়াবেটিস হলেই যে কিডনির অসুখ হবে সেটি কিন্তু নয়। একইভাবে কিডনিতে পাথর হওয়ার জন্য ডায়াবেটিসের কোনো ভূমিকা নেই। তাই আমরা রুটিন পরীক্ষায় দেখতে পারি, কিডনিতে অ্যালবুমিন গেলে এটি কিডনির প্রাথমিক রোগ।
এখন আপনি বলতে পারেন, আমার কিডনি রোগ হয়ে গেছে কী হবে? কিডনির অসুখ হলে অ্যালবুমিন যেতে পারে। বেশি অ্যালবুমিন হলে ইডিমা হতে পারে। বেশি অ্যালবুমিন গেলে কোলেস্টেরল বেড়ে যেতে পারে। বেশি অ্যালবুমিন গেলে সারা শরীর ফুলে যেতে পারে। আরেকটি হলো যে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।
এখন উচ্চরক্তচাপ কিডনির অসুখের জন্যও বাড়তে পারে। ডায়াবেটিসের জন্যও হতে পারে।
প্রশ্ন : যিনি ডায়াবেটিক রোগী তার জটিলতাগুলোকে কীভাবে প্রতিরোধ করতে পারি?
উত্তর : প্রথম কথা হলো প্রাথমিক প্রতিরোধ। কিডনিতে যেন অসুখ না হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তার রাস্তা কী? একটিই রাস্তা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আরেকটি হলো এমন কোনো ওষুধ দেওয়া যাবে না রোগীকে যাতে কিডনিতে সমস্যা হতে পারে।
ডায়াবেটিস রোগীর রক্তচাপ আছে আপনি ব্যথার ওষুধ দিয়ে দিলেন। তাহলে তো হবে না। পাশাপাশি কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলো দেওয়ার আগে চিন্তা করতে হবে যে কিডনির অসুখ হতে পারে।
আর যার ডায়াবেটিসে কিডনির রোগ হয়ে গেছে, যদি মাইক্রোঅ্যালবুমিনিউরিয়া হয়, তাহলে এটি হলো প্রাথমিক পর্যায়। এই সময় আলট্রাসোনো করলে দেখা যাবে কিডনি একটু বড় হয়ে গেছে। ডায়াবেটিসের কারণে বড় হয়ে গেছে। তখন যদি ডায়াবেটিস ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিছু ওষুধ দেওয়া যায় তাহলে আর হবে না। কিডনির অসুখ ঠেকানো গেল। তবে যখন বেশি প্রোটিনিউরিয়া হয়ে যাবে, তখন পাঁচ বছরের চক্র হয়ে গেল। পাঁচ বছর বেশি প্রোটিনিউরিয়া হবে। রেনাল ফেইলিউর হবে। তখন রোগীকে মোটামুটি একটি পরামর্শ দিতে হবে যে এই জিনিসগুলো হতে পারে। এতে রোগী সচেতন হবে। ওষুধ খাওয়ার আগে হিসাব করবে। বা অন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে হিসাব করে যাবে। বা রুটিন পরীক্ষা ঠিকমতো করবে।
এখন যার ডায়াবেটিস হয়ে প্রোটিনিউরিয়া হয়ে গেছে তাকে সাধারণত কিছু ব্যবস্থাপনা দেই এতে প্রোটিনিউরিয়া কমে। উচ্চ রক্তচাপ কমাতে হবে। আর কিছু কিছু ওষুধ তো আমরা এড়িয়েই যাই। এটি হলো প্রোটিনিউরিয়ার বিষয়। খাবারে প্রোটিন খাওয়ার বিষয়ও হিসাব করে খেতে হবে।
আরেকটি হতে পারে রেনাল ফেইলিউর। এটি হলে আপনার রক্তচাপ বাড়বে। রক্তস্বল্পতা হবে। সংক্রমণ হবে। প্রোটিন কমে যাবে। শরীর ফুলে যাবে। পাশাপাশি সারা শরীর চুলকাবে। বমি বমি লাগবে। সব সিস্টেমিক লক্ষণগুলো শুরু হবে। মস্তিষ্ক কম কাজ করবে। রেনাল ফেইলিউরের কিছু পর্যায় আছে। এ ক্ষেত্রেও আমাদেরে চিকিৎসা করার বিষয় রয়েছে।
এখন যদি রোগীকে বলা হয়, তোমার কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে তাহলে কিন্তু খারাপ। একজন চিকিৎসক কখনো এভাবে কথা বলতে পারেন না। বলতে পারেন তোমার কিডনির ক্রিয়েটিনিনটা একটু বাড়ছে। দেখা যাক কী হয়? এমনভাবে বলতে হবে।
প্রশ্ন : প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আপনি কী পরামর্শ দেবেন?
উত্তর : আমি বলব, যদি কিডনির অসুখ হয়ে যায়, তখন আমাদের সেকেন্ডারি প্রতিরোধ লাগবে। মানে রোগটি আর যাতে বাড়তে না পারে, সেটা চেষ্টা করতে হবে।
ক্রিয়েটিনিন সরাসরি কমানোর কিছু নেই। আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখেন, প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখেন এটি বাড়বে না। যদি এক রকমভাবে পাঁচ বছর থেকে যায় সমস্যা কী? কিছু হবে না। তাহলে এটি আমাদের লক্ষ্য।
আমাদের প্রথম লক্ষ্য হবে উচ্চ রক্তচাপ ঠিক করা। দ্বিতীয় হলো, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা। ডায়াবেটিসে কিডনির ক্রিয়েটিনিন ১ দশমিক পাঁচ হলে মেটফরমিন ওষুধ দেওয়া যায় না। এনএসআইডি, ব্যথার ওষুধ এটি দেওয়া যাবে না। এ রকম অনেক ওষুধ আছে যেগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। আবার প্রোটিন বেশিও খাওয়া যাবে না।
আরেকটি জিনিস দেখে ইজিএফআর দেখে। এটি দেখা কিডনির অসুখের পর্যায় দেখা হয়। আমরা সার্বিকভাবে বলতে পারি, আপনার কিডনির অসুখ হয়েছে। আপনার হিমোগ্লোবিন কম থাকতে পারে। চিকিৎসা করে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে হবে।
কিডনির অসুখ হলে শরীর থেকে একটি জিনিস বের হয়। ইরিথ্রোপয়েসিস। এটা হিমোগ্লোবিন বাড়ায়। এটি বাইরের থেকে দেওয়া যেতে পারে। যদিও দামি, তবুও দেওয়া যেতে পারে। প্রোটিন হিসাব করে খেতে হবে। পানি হিসাব করে খেতে হবে। লবণ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম এগুলো হিসাব করে খেতে হবে। ক্যালসিয়াম, ফসফেট এগুলো হিসাব করে দিতে হবে। যাতে রোগ বৃদ্ধিটা কমে আসে।
শেষ কথা হলো, সব কিডনির অসুখেই ডায়ালাইসিস লাগার আশঙ্কা রয়েছে। কখন ডায়ালাইসিস লাগবে সেটি রোগীকে আগে থেকেই বলা উচিত। তবে ক্রিয়েটিনিন তিন হওয়ার আগে কাউকে এসব কথা না বলাই ভালো। কারণ ক্রিয়েটিনিন যখন তিন হয় তখন মোটামুটি বেশি। ছয় হলে মোটামুটি ধারণা করা হয় এর ডায়ালাইসিস লাগবে। ১০ হলে ডায়ালাইসিস লাগে। এ জন্য রোগীকে আগে জানানো ভালো।