মহৎ পেশার মানুষ
সাবরিনা আরিফ চৌধুরী, দেশের অন্যতম নারী কার্ডিয়াক সার্জন
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/03/26/photo-1458994225.jpg)
ছোটবেলায় বাবার কড়া শাসনের মধ্যে বড় হতে হয়েছিল মেয়েটিকে। সারা দিন পড়া আর পড়া। টিভিও দেখতে দিতেন না বাবা। তাই কত যে শখ জীবনে অপূর্ণ রয়ে গেছে! তবে এখন এসে মনে হয়, বাবা হয়তো ভালোই করেছিলেন। তাই তো ডাক্তার হওয়াটা হয়েছিল তাঁর।
যার কথা বলছি, তিনি বাংলাদেশের অন্যতম নারী কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। মিষ্টভাষী, শান্ত স্বভাবের এই মানুষটি এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন তাঁর চিকিৎসক হয়ে ওঠার গল্প।
কার্ডিয়াক সার্জন হলাম যেভাবে
আমরা দুই বোন ছিলাম। সবাই বলত, ‘হয়েছ তো মেয়ে, বাবা মরে গেলে তো লাশটাও কাঁধে নিতে পারবে না’। এসব কথা খুব আহত করত। ভাবতাম, এমন কিছু করব যাতে লাশ কাঁধে নিতে না পারি, তবে যেন বাবা জীবিত থাকতেই তাঁর মাথা উঁচু করতে পারি। মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে কেউ যেন করুণার চোখে না দেখে, সব সময় এটাই চেয়েছি।
আর আমি আমার দেশকে অনেক ভালোবাসি। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য সব সময় কিছু করতে চাইতাম আমি। এটি থেকেও ডাক্তার হওয়ার একটা ইচ্ছা তৈরি হয়।
পাস করার সময় মনে হয়েছে গাইনিতে পড়ব। তবে এরপর মনে হয়েছে গাইনি পড়ার মধ্যে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। আমি এমন কিছু করতে চাইতাম যেটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। আর হার্টের বিষয়ে পড়তে আমার ভালো লাগত। তাই কার্ডিয়াক সার্জারিতে পড়তে শুরু করি।
ছয় বছর কার্ডিয়াক সার্জারি পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে অবসন্ন লেগেছে। তবে এগিয়ে গিয়েছি।
আমার কাজ করতে অনেক ভালো লাগে। যখন অ্যাপ্রোন পরি, যখন অপারেশন থিয়েটারে ঢুকি, হার্ট কাটি, তখন আমার মাথায় আর কিছু থাকে না। কেবল আমার কাজ থাকে। অন্য জগতের মানুষ হয়ে যাই।
একটি নারীকে যোগ্য হয়ে উচ্চ পদে যেতে হলে পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ পরিশ্রম করে যেতে হয়। আমি মনে করি, কোনো কিছুতে একমাত্র মেয়ে হওয়া ভালো নয়। এই সেক্টরে আরো অনেক মেয়ের আসা উচিত। নয়তো রোগীরা নারী চিকিৎসকের ওপর আস্থা রাখতে পারবে না।
ছোটবেলার কোনো মজার ঘটনা নেই আমার
আমার ছোটবেলা কেটেছে হল্যান্ডে। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তিনি সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি খুব কড়া লোক ছিলেন। আমাদের কখনো গান শুনতে দিতেন না, টিভি দেখতে দিতেন না। ভাবতেন গান শুনলে মনে প্রেমভাব তৈরি হবে! সারা দিন কেবল পড়া পড়া আর পড়া। আমার ছোটবেলায় কোনো মজার ঘটনা নেই। অনেকে শৈশবে ফিরতে চায়। আমি চাই না।
তবে ছোটবেলায় নাচ শিখেছি। বাবার থেকে লুকিয়ে, মায়ের সহযোগিতায়। মা লুকিয়ে আমার জন্য নাচের অ্যারেঞ্জ করত। এখন মাঝে মাঝে চিকিৎসকদের অনুষ্ঠানে নাচ করি আমি।
আমার যখন দু্ই মাস বয়স তখন আমার পরিবার নেদারল্যান্ডসে চলে যায়। সেখানে অ্যাম্বেসির মাধ্যমে এসএসসি পরীক্ষা দিই।
এরপর আমার পুরো পরিবার আমেরিকায় স্থায়ী হয়ে হয়ে যায়। তবে আমি দেশে চলে আসি। এখানে মেডিকেল পড়ার সুযোগ পাই। এখানে এসে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। এরপর প্রশিক্ষণ নিই ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এমএস করেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
নায়িকাও হতে চেয়েছিলাম
নায়িকাও হতে চেয়েছিলাম একসময়। হা হা হা। তবে বাবার কড়া শাসনের কারণে আর সেটি হয়ে ওঠেনি। নায়িকা হওয়ার জন্য প্রস্তাবও পেয়েছিলাম। লুকিয়ে অভিনয়ের রিহার্সেলে যেতাম। তবে যেদিন ফাইনাল শুটিং হবে সেদিন বাবা বুঝে গেলেন সবকিছু। আমার আর অভিনয় করা হলো না।
চাকরি পাওয়ার পর আমার প্রথম পোস্টিং হয় দিনাজপুরের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এমন একটি জায়গা ছিল, যেখানে কাটাকুটি করার মতো কোনো যন্ত্র নেই। কোনো রকমে কিছু ওষুধ আসত।
সেখানে থেকে আমার মনে হয়েছে এসব জায়গাগুলো উন্নত করা যায়, তাহলে অনেক চিকিৎসক গিয়ে কাজ করত। তবে নেই বলেই কাজ করার সুযোগ সেসব জায়গায় কম। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে বদলি হই। এখন কাজ করছি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে।
সারা বিশ্বেই নারী কার্ডিয়াক সার্জনের সংখ্যা কম। যেখানেই গিয়েছি অনেক সমাদর পেয়েছি। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে নারী কার্ডিয়াক সার্জন রয়েছে এটি ভেবে অনেকেই খুব অবাক হয়েছেন।
যেতে হবে বহুদূর
আমি এতদিন কেবল দৌড়েছি একটি ভালো প্লাটফর্মে কাজ করার জন্য। এখনই আসলে মূল কাজ শুরু হয়েছে। যেতে হবে আরো অনেক দূর। আরো অনেক কাজ করতে হবে। সামনের পথ আরো বেশি কঠিন।
এখানে আসতে পুরুষের থেকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেক বেশি সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হয় সম সময়। একজন মানুষ নিজের হার্টটি একজন নারীকে কাটতে দিয়ে দেবে—ব্যাপারটি সহজ নয়। এ জন্য অনেক যোগ্য হতে হয়েছে। এখন পুরো দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। আমি জীবনে যেটি চেয়েছি, সেটি পেয়েছি। এখন মানুষের জন্য আরো কাজ করতে চাই।
রোগীদের ভালোবাসাই আমার পাওয়া
রোগীরা যখন দোয়া করে, ভালোবাসে—একে আমার বড় পাওয়া বলে মনে হয়। এমনও হয়েছে সার্জারির পর অনেক দূর থেকে রোগী আমার কাছে এসেছে কেবলমাত্র সেলাই কাটার জন্য। এটা অনেক বড় পাওয়া বলে মনে হয়।
একবার একজন দরিদ্র রোগীকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছিলাম। কিছুদিন পর সে রিকশা চালিয়ে আমার জন্য একটি শাড়ি নিয়ে এসেছিল। শাড়িটি আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি। ভীষণ আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম সেদিন।
অনেক রোগীই তার বাচ্চার নাম আমার নামে রেখেছে—এগুলোও আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া বলে মনে হয়। এই দোয়াটা অনেক বড় কিছু।
অনেকের মধ্যেই একটি প্রবণতা থাকে, কেবল বড় ডাক্তারদের কাছে যাওয়ার। এতে একজন চিকিৎসকের প্রতি অনেক বেশি চাপ পড়ে যায়। যেহেতু পরিশ্রম বেশি করতে হচ্ছে, এ জন্য হয়তো সম্মানী বেশি নেয় বা রোগীকে কম সময় দিয়ে দেখে। ডাক্তারদের যেমন রোগীর প্রতি ভালোবাসা থাকা দরকার, তেমনি রোগীদেরও উচিত চিকিৎসকদের প্রতি সম্মান দেখানো।
পরিবারের লোকদের সহযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছি
আমার কাজের ব্যাপারে পরিবারের লোকেরা অনেক সহযোগিতা করে। বিশেষ করে আমার স্বামী আমাকে এ বিষয়ে অনেক সহযোগিতা করে। সে সব সময় আমাকে কাজ করার জন্য আগ্রহ জোগায়। আমি তার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।
যারা আসতে চায় এই পেশায়
কার্ডিয়াক সার্জন হতে হলে অনেক বেশি সময় দিতে হয়। কেন না একটি অস্ত্রোপচারের পর বলা যায় না রোগীটির কী হবে। ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের মধ্যে রোগীকে রাখতে হয়। তাই যারা অনেক পরিশ্রম ও শ্রম দিতে পারবে, তাদেরই কার্ডিয়াক সার্জারি পেশায় আসা উচিত।
স্বপ্ন দেখি অনেক
বাংলাদেশে এখনো হার্ট ট্র্যান্সপ্লানটেশনের ব্যবস্থা চালু হয়নি। এটি চালু করার চেষ্টা চলছে। এটি নিয়ে কাজ করার চিন্তা চলছে। এটি হলে এর সঙ্গে যুক্ত হতে চাই।
আমি চাই গরিব রোগীদের সেবা করতে। তাই সব সময় সরকারি হাসপাতালে কাজ করতে চাই। বেসরকারি হাসপাতালে যেতে চাই না। সেখানে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ কম। দেশের মানুষের জন্য কাজ করব এটিই আশা।