সহকর্মী যখন মানসিকভাবে অসুস্থ
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/03/25/photo-1427276317.jpg)
গত মাসে পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে ফিরে আবার চাকরিতে যোগ দিয়েছে মিজান (ছদ্মনাম)। একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে মাদক গ্রহণ শুরু করেছিল সে। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, সে মানসিকভাবে এতটাই অসুস্থ যে তাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকতে হবে। এজন্য অফিস থেকে ছয় মাসের ছুটি নেয় মিজান।
মিনারা ইসলাম (ছদ্মনাম)। স্বামীর সঙ্গে কলহের কারণে ভীষণভাবে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে সে। মনোচিকিৎসকের কাছে যেতে হচ্ছে তাকে। এমন অবস্থায় চাকরিটিও চালিয়ে যেতে হচ্ছে মিনারাকে। বেশির ভাগ সময় অফিসে গিয়ে খুব মন খারাপ লাগে তার। সংকোচে সহকর্মীদের বলতেও পারে না নিজের সমস্যার কথা।
ওপরের দুজনের মতো কোনো সহকর্মী যদি মানসিকভাবে অসুস্থ হয় তবে অন্যদের আচরণ কী হবে এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তানজির আহম্মদ তুষার বলেন, মানসিক সমস্যা সবারই হতে পারে,এ বিষয়ে সব মানুষেরই সচেতন থাকা দরকার। সাধারণত আমরা যদি শারীরিকভাবে অসুস্থ হই তাহলে হয়তো দেখা যায় অফিস থেকে ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ এই বিষটিতে আমাদের সমাজ এখনো সহজ হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রেই মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে স্বাভাবিকভাবে দেখা হয় না। প্রচলিত দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে দুর্বল মানসিকতার ভাবা হয়। এ মনোভাবের পরিবর্তন দরকার।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তুষার বলেন,ভীষণ মানসিক অসুস্থতা নিয়েও সুন্দরভাবে কাজ করা সম্ভব যদি সে একটু সাহায্য পায়। বিশেষ করে যারা অফিসে কাজ করে তাদের ক্ষেত্রে। যদি জানা যায় কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ তাকে সাহায্য করা দরকার। সবার জীবনেই মানসিক সমস্যা আসতে পারে- এটি ভেবে তাকে সাহায্য করা উচিত। আর মানসিকভাবে অসুস্থ হলেই যে সে কাজ করতে পারবে না বিষয়টি একদমই তা নয়। খুব মানসিক চাপ নিয়েও যে সুস্থ জীবনযাপন করা যায়, সুন্দরভাবে কাজ করা যায় সেটা জানতে হবে। তাই কাউকে নিয়ে কানাঘুষা করা ঠিক নয়। যে কোনো মানুষেরই এই ধরনের সমস্যা থাকতে পারে, এটা ভাবা দরকার।
কোনো কর্মী হয়তো অফিসে এসে বলল, স্যার খুব মন খারাপ, মানসিক চাপ যাচ্ছে,কিছুদিন ছুটি দরকার। এগুলোকে সহজভাবে নিয়ে তাকে কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়ার সময় দেওয়া প্রয়োজন। আর সাহায্য করার মানসিকতা থাকা দরকার, বিশেষ করে বর্তমান চাপযুক্ত জীবনে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক অভ্রদাস ভৌমিক জানান, মানসিক রোগ বিভিন্ন ধরনের হয়: লঘু মানসিক রোগ এবং গুরুতর মানসিক রোগ। লঘু মানসিক রোগের মধ্যে রয়েছে ডিপ্রেশন, এংজাইটি ,শুচিবাই,এডজাস্টমেন্টে ডিসঅর্ডার ইত্যাদি। গুরুতর মানসিক রোগের মধ্যে আছে সিজোফ্রেনিয়া,বাই পোলার মুড ডিস অর্ডার ইত্যাদি।
মানসিক রোগ খুব গুরুতর না হলে একজন মানুষ বেশ সফলভাবেই তার দৈনন্দিন কাজগুলো করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সহকর্মীরা যদি জানেন ব্যক্তিটিকে মানসিকভাবে সাহায্য করা খুব জরুরি,তাহলে তাকে কাজের ক্ষেত্রে চাপ কম দিতে পারলে ভালো। অন্যদিকে ছোটখাট ভুলের জন্য তিরস্কার করা উচিত নয়। অফিস হয়তো ভাবতে পারে এতে তাদের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু একটা সময় এই কর্মীটিই হয়তো সবচেয়ে ভালো পারফরমেন্স দেখাতে পারবে, যদি সে তার খারাপ সময়ে অফিসের সহযোগিতা পায়। বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখাও জরুরি।
কর্মীকে কাজের ফাঁকে বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন। তাকে বলা উচিত, আপনার এই অবস্থায় আপনি যতটুকু কাজ করছেন সেটিই যথেষ্ট। তার সঙ্গে ইতিবাচকভাবে কথা বলতে হবে। যদি সম্ভব হয় এবং যদি অর্থনৈতিকভাবে সাহায্যে প্রয়োজন হয় তাহলে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করাও প্রয়োজন। তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে সাহায্য করা দরকার। যতটুকু সম্ভব তার কাজকে সম্মান করা উচিত। নেতিবাচক বিষয় বারবার না বলে ইতিবাচক বিষয় সামনে আনা উচিত।
অভ্রদাস ভৌমিক বলেন, তবে গুরুতর মানসিক রোগে একবার আক্রান্ত হলে সুস্থ হওয়ার প্রথম দিকে কর্মী ভারি কাজ করতে পারে না। এ সময় কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ দিতে হবে।
অভ্রদাস ভৌমিক আরো বলেন, এসব রোগে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। অন্যান্য রোগের মতো মানসিক সমস্যায় ভুক্তভুগীকে সাহায্য করলে তারাও সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে পারবে। নিজে রোজগার করতে পারবে। নয়তো মানসিক রোগী হিসেবে পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এই রোগের চিকিৎসা দরকার। এসব আক্রান্ত ব্যক্তি কাজের বিষয়ে অনেক সৎ হয়ে থাকে। তাদের সম্মান দিলে তারা আরো কাজ করতে উৎসাহী হয়।
তবে এসব ব্যক্তিকে পাবলিক ফাংশনের কাজ দেওয়া ঠিক হবে না জানিয়ে তুষার বলেন, নিজের মতো কাজ করতে পারবে এমন কাজ দিতে হবে। যেসব কাজে বাড়তি চাপ নেই এ ধরনের কাজ দেওয়াই ভালো। অতিরিক্তি সমালোচনা না করে তাকে সাহায্য করতে হবে।
রোগী কী করবে
এসব ক্ষেত্রে মানসিক রোগী কী করবে এ বিষয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তুষার বলেন, একেকজন মানুষের একেক ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। তার কী ধরনের সাহায্যের দরকার তা আগে থেকে অফিসের কাছে চাইতে হবে। কী ধরনের সাহায্য তার দরকার এ বিষয়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে নিতে পারে। তবে সহকর্মী হয়তো সবসময় বন্ধু হয়ে যায় না। তাই বুঝতে হবে আমি যাকে বলব সে সেই কথার সুযোগ নেবে কি না। এমন কারো সঙ্গে কথা বলতে হবে যে বিষয়টি বুঝবে। অফিসের বসের কাছে সাহায্য পেলে ভালো হয়।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক নেতিবাচক ধ্যানধারণা দূর করতে হবে। অর্থাৎ মানসিক রোগী মানেই খারাপ এ ধরনের মানসিকতা দূর করা জরুরি।