চোখের যত্ন নেবেন যেভাবে
চোখ শরীরে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাই এর যত্ন নেওয়া জরুরি। চোখের যত্ন কীভাবে নিতে হবে- এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩৭৮তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহম্মেদ। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও চক্ষু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : চোখের যত্ন বলতে আসলে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : চোখ মানুষের জীবনে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অঙ্গ। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা চোখ আক্রান্ত হয়। প্রথমেই যদি বলি, একটি শিশু জন্মের পর চোখ দিয়ে পানি পড়ে। আবার কোনো কোনো শিশু দেখতেই পায় না।
জন্মের পর যদি তার ওজন কম থাকে, তাহলে র্যাটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচিউরিটি বলে একটি রোগ হয়। নবজাতক যারা তাদের স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে লেজার করে দৃষ্টি ফেরানো যায়। অতীতে সারাজীবন অন্ধই থাকত। এই যে চোখে পানি পড়ে মায়েদের খুব কষ্ট। এই সময় সাথে সাথে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত এবং ম্যাসেজ দিয়ে, অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সমস্যা ভালো করা যায়।
হাসপাতালে নবজাতকের ওয়ার্ড আছে। র্যাটিনোপ্যাথি অব প্রিমেচিওরেটির ক্ষেত্রে ওয়ার্ডগুলোতে অপথালমোলজিস্টরা গিয়ে তার চোখের ভেতর, র্যাটিনায় কোনো সমস্যা আছে কি না- এটি পরীক্ষা করে। পরীক্ষা করে অন্ধত্ব নিবারণের জন্য লেজার দিয়ে আমরা ভালো করে দেই। এটা আধুনিক একটি চিকিৎসা।
প্রশ্ন : এতে কী সমস্যা থাকে?
উত্তর :এতে রোগী চোখে দেখতে পায় না।কোনো একটি জিনিস অনুসরণ করে না। জন্মের পর পরই যদি এটি পরীক্ষা হয়, পরে তার আর চোখ ভালো করা যায় না। তাই জন্মের পর পরই চোখ পরীক্ষা করতে হবে।
আরেকটা জিনিস হলো অনেক মা অভিযোগ করে আমার দিকে তাকায় না। জন্মগত ছানি নিয়ে শিশু আসতে পারে। ছানি যদি জন্মগতভাবে নিয়ে আসে চক্ষু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে দুই মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে আমরা তার অস্ত্রোপচার করে ফেলব। তা না হলে শিশুটির অ্যাম্বোলয়পিয়া হয়ে যায়। সে আর ভবিষতে দেখতেই পারে না। তাহলে এটি হলো বাচ্চাদের জন্য।
এবার আমরা একটু বড় বয়সের দিকে থাকি। এই যে এখন প্রচুর গরম।গরমের সময় অনেকের চোখ উঠছে।চোখ ওঠা রোগে চোখ লাল হয়,ঝাপসা দেখে,পানি পড়ে। এ ছাড়া অনেকের দেখা যায় ভাইরাল ইনফেকশন হয়, মণিতে বা কর্নিয়াতে সমস্যা হয়। এই গরমের সময় বেশি রোদে না গিয়ে, সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে। আর চোখ ওঠার সাথে সাথেই চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলেই আমরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
আরো একটি বিষয় বলি, অনেকে চোখ ওঠাকে সাধারণ মনে করে চিকিৎসকের কাছে যায় না। ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে ব্যবহার করে তার চোখকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে যে চোখের ক্ষতি হয়। রোগটি যদি ভাইরাল হয়, তাহলে ওই চোখের মণির ওপরে একটি আবরণ পড়ে যেতে পারে। এটি ভবিষ্যতে দৃষ্টিশক্তির ওপর আঘাত হানতে পারে।
চোখ লাল হলো বা চোখে ময়লা ঢুকলে, রাস্তার একটি লোক দিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ পরিষ্কার করলে চোখের ক্ষতি হতে পারে।
আবার লেদ মেশিনে কাজ করে অনেক বাচ্চা। সাধারণত শিশু শ্রমিকদের নিষেধ করা হয় তারা যেন কাজ না করে। লেদ মেশিন থেকে লোহার টুকরা এসে চোখে লাগতে পারে। এই জন্য সুরক্ষামূলক গ্লাস ব্যবহার করা উচিত। এগুলো চোখের যত্নের একটি অংশ। যদি এই লোহার টুকরা থেকে যায়, আর বের না করা হয় কর্নিয়া থেকে, তাহলে ঘা হয়।
তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকরা বের করে দিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভালো হয়ে যায়। এ রকম সমস্যা হলে দেরি করা যাবে না। চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
এ ছাড়া ধান মাড়াইয়ের সময়, পাট মাড়াইয়ের সময় দেখা যায় অনেকে মণিতে আঘাত পায়। এতে ঘা হয়ে যায়। একে আমরা ফাঙ্গাল কর্নিয়াল আলসার বলি।
কৃষকরা যখন ধান মাড়াই করবে, পাট মাড়াই করবে, সেই সময় যেন চোখে একটি চশমা পরে নেয়। বর্তমান সরকারের ন্যাশনাল আই কেয়ার প্ল্যানের মাধ্যমে একটি পরিকল্পনা আছে, আমরা গ্রামাঞ্চলে বিনামূল্যে এই চশমা দেই।
গ্রামের কৃষকরা যদি এই সমস্যার সমাধান চায়, তাহলে স্থানীয় জেলা হাসপাতাল বা উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে তারা চাইলে এটা পাবে। ন্যাশনাল আই কেয়ার প্ল্যানের মাধ্যমে।
এটা অনেকে জানে না। এই মিডিয়ার মাধ্যমে আমি তাদের আহ্বান জানাব যে চোখ রক্ষা করার জন্য, চোখে ঘা না হওয়ার জন্য, অবশ্যই যেন কাজ করার সময় শূন্য পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করে। ১০০ টাকারও কম দামে পাওয়া যায় চশমা। আর আমরা তো বিনামূল্যেও দেই।
এই যে ঘা-টা হলো সে তো বোঝে না। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। গোলাপজল বা শামুকের পানি তখন চোখে ব্যবহার করে। কারো কাছে গিয়ে ঝাড়ফুঁকের পানি দেয়। এগুলো যেন না করে।
এটা আগে বেশি ছিল। এখন অনেকটা কমে এসেছে। সে চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবে। এ সময় চোখ লাল হয়। আলোতে যেতে পারে না। চোখ ছোটো হয়ে যায়। দেখতে অসুবিধা হয়। ব্যথা হয়। এই চোখের ঘা হওয়ার সাথে সাথে চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলে, তারা সুস্থ থাকবে।
এ ছাড়া চোখে আরো বেশ কয়েকটি রোগ আছে। যেটা আমাদের সবার জানা উচিত। যেমন বয়স হলে চোখের যে লেন্সটা আস্তে আস্তে তার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এটি হারিয়ে ফেলার কারণে অনেকের ছানি হয়। ছানি ঠিক করা যায়।
বহুজনের ক্ষেত্রে আমরা ফ্যাকোসার্জারি করে দিয়েছি। কেউ বুঝতেও পারে না তার চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তারা বলেন, এখন অনেক ভালো দেখেন। কারণ, নয় বছরের যে দৃষ্টি সেটা আমরা এনে দিতে পারি কৃত্রিম ফ্যাকো সার্জারি দিয়ে।
৪০ বছর বয়স হলে আরেকটি পরামর্শ আমার। অনেকেই দেখবেন মোবাইল ফোনের নম্বর দেখতে পায় না। পত্রিকা পড়তে পারে না। ছেলেমেয়েকে বলে পড়ে দাও। ৪০ পেরুলে চালশে একটি রোগ হয়। প্রত্যেকের এই ক্ষেত্রে চশমা পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। এতে তার কাজের গতি বাড়বে।
ছানি পড়লে আজকাল আমরা বলি ওয়াশ করতে হবে। এটি হলো নেত্রনালি বন্ধ হয়ে গেলে, চোখ দিয়ে পানি গেলে নাকে বা গলায় গেল কি না জিজ্ঞেস করি। তেমনি করে ফ্যাকোসার্জারিতে চোখের লেন্সটা বের করে আনি, মেশিনের সাহায্যে গুঁড়ো করে। এরপর একটি কৃত্রিম লেন্স বসিয়ে দেই। তাহলে সে একদম স্বাভাবিক হয়ে যায়। দুই ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ফিরে যেতে পারে।
এ ছাড়া আরেকটি রোগ আছে। সাধারণ মানুষের জন্য আমি বলব, উচ্চ রক্তচাপ থাকে মানুষের। চোখেও তেমন একটি চাপ থাকে। চোখের এই চাপ আছে কি না বা গ্লুকোমা আছে কি না- এটা দেখা উচিত। চোখের এই গ্লুকোমার একটি খারাপ দিক আছে। চোখ লাল হয়, ব্যথা হয়, এ রকম একটি গ্লুকোমা আছে। একে বলে একিউট কনজেসটিভ গ্লুকোমা। আরেকটি গ্লুকোমা হলো তুষের আগুনের মতো। এই গ্লুকোমাটা মানুষ বুঝতে পারে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেই আমরা বুঝতে পারি তার গ্লুকোমা আছে। তাই গ্লুকোমা আছে কি না এটি দেখার জন্য অবশ্যই চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
চক্ষুবিশেষজ্ঞদের কাছে অনুরোধ যারা তাদের দেখাতে আসে তাদের ডিস্ক ঠিক আছে কি না আর গ্লুকোমা আছে কি না এটা যেন দেখে।
মানুষের শরীরে তো অনেক ক্যানসার হয়, চোখেও ক্যানসার হয়। তো অনেকে বুঝতে পারে না। টিউমার হয়। ডায়াবেটিসের কারণে র্যাটিনোপ্যাথি হয়। উচ্চ রক্তচাপ হলেও চোখের ভেতর র্যাটিনোপ্যাথি হয়। আমি মনে করি, এসব বিষয় যদি সবাই বিবেচনা করে তাহলে চোখের যত্ন সঠিক হবে এবং চোখের যত্ন সঠিক হলে দৃষ্টি শক্তি ভালো থাকবে। স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সহজ হবে।