সোয়াইন ফ্লু কী?
বর্তমানে সোয়াইন ফ্লু নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এ রোগ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এটি অনেক সময় মহামারি আকার ধারণ করে। আজ ৩০ মার্চ এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৯০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে সোয়াইন ফ্লু তেমন দেখা যায় না। তবুও এই বিষয়ে আমরা বেশ সচেতন। পৃথিবীতেই মাঝে মাঝে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শোনা যায়। আমরা সংবাদ মাধ্যমে দেখি এ নিয়ে বেশ তোড়জোড়। সোয়াইনফ্লু কী এবং এটি নিয়ে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী?
উত্তর : সোয়াইন ফ্লু আর অন্যান্য সব ভাইরাসের মতো একটি ভাইরাস, যেটাকে আমরা বলি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। ফ্লু যেটা হয়, মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত যে হাঁচি-কাশিটা লেগে থাকে এই একই ভাইরাস-জাতীয় একটি ভাইরাস এটি। তবে সাধারণ যে ভাইরাসগুলো দিয়ে আক্রান্ত হয় সেগুলো থেকে কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সোয়াইন ফ্লু বা বার্ড ফ্লু, এই ভাইরাসগুলো আমাদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। ভয়ের কারণ হচ্ছে আমাদের পাশের দেশ ভারতে এটি চলে এসেছে। যখন কোনো জায়গায় হয় তখন আমরা বলি এপিডেমি। ২৫ হাজারের বেশি রোগী এ সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে। সেখানে প্রায় এক হাজার ৫০০ জনের মতো লোক মারা গেছে। এমনকি আমাদের পাশের রাজ্য, পশ্চিমবাংলা, সেখানেও একাধিক লোক মারা গেছে। এটা যেহেতু প্রচণ্ড ছোঁয়াচে ভাইরাস তাই আমাদেরও এটা হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন : ছাড়ায় কেন? আমাদের পাশের একটা দেশের এই সমস্যা হলে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কী আছে?
উত্তর : আর পাঁচটা ভাইরাসের মতো হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এটি ছড়ায়। আমরা যখন হাঁচি-কাশি দেই তখন ড্রপলেট হয়। এর মাধ্যমে জীবাণুটা ছড়ায়। যখন হাঁচি বা কাশি দিলাম তখন পাশের ব্যক্তিটি আক্রান্ত হয়ে যাবেন। হাঁচি দেওয়ার পর রুমাল ব্যবহার না করে যদি নাকটা ধরা হয় এবং এরপর যদি সামনে একটি গ্লাস থাকে সেটি ধরি আবার সেই গ্লাস যদি আপনি ধরেন এর মাধ্যমে জীবাণু ছড়াবে। এমনকি ১০ ঘণ্টা পরও যদি আপনি হাত দিয়ে এটি ধরেন তখনো কিন্তু আক্রান্ত হয়ে যাবেন। সোয়াইন ফ্লুও মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে। কেননা এটার উৎপত্তি হচ্ছে সোয়াইনের মাধ্যমে।
একজন রোগী যদি জীবাণুর মাধ্যমে জ্বরে আক্রান্ত হয় সেই জ্বর চলে আসার একদিন আগেও কিন্তু তার মধ্যে অন্যকে আক্রান্ত করার ক্ষমতা চলে আসে। বড়দের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার সাত দিনের মধ্যে সে অন্যকে এই রোগ ছড়াতে পারে। তাই ওই রোগী যখন লোকালয়ে যাবে তখন রোগ ছড়াতে পারে। সে জন্য এটি মহামারি আকারে ছড়ানো শুরু করে। এই ভাইরাসগুলোকে আমরা বলি এসোরটেট ভাইরাস। এর দুটি টার্ম রয়েছে। সোয়াইন ফ্লুকে আমরা বলি এইচ-ওয়ান এন-ওয়ান। মানুষের জন্য যেই এইচ-ওয়ান এন-ওয়ান হচ্ছে সেটি একটু আলাদা, শুকরের জন্য যখন হচ্ছে সেটা আলাদা, আবার যখন পাখির জন্য হচ্ছে সেটা একটু আলাদা। এখন দেখা যাচ্ছে, মানুষের ভাইরাসটি ওই প্রাণীর মধ্যে আক্রান্ত হয়ে গেল। ভাইরাসের দুটো জিন মিলিয়ে নতুন একটি জিন তৈরি হলো। সোয়াইনের জন্য যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সেটা আমাদের আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু পরবর্তী এসোরেটেট ভাইরাসটি আমাদের আক্রমণ করে। কিন্তু সাধারণ সিজনাল ফ্লু তেমন ক্ষতি করে না।
প্রশ্ন : কোনো ব্যক্তি যখন সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হয় সেটা বোঝার কী কোনো উপায় আছে?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে সাধারণত যদি কিছু জটিলতা তৈরি হয় তখন আমাদের মাথায় বিষয়টি আসে। যে দেশে সোয়াইন ফ্লু আছে সে দেশে যদি কেউ যায় তখন এই সমস্যা হতে পারে। ২০০৯ সালে যেটা ছিল সেটা হলো পেন্ডিমিক অর্থাৎ আশপাশের অনেক দেশে এ সমস্যা হয়েছিল । কিন্তু এখন এন্ডিমিক অর্থাৎ শুধু একটি দেশে এই সমস্যা হয়েছে। তাই যেকোনো কারণে ভারতে গেলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ওখান থেকে চলে আসার পর যদি সর্দি-কাশি, জ্বর হয় ধরে নিতে হবে সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
এর তীব্রতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশি হয়। বয়স যদি পাঁচ বছরের কম হয়, ৬৫ বছরের বেশি হয়, গর্ভবতী মা হয়, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার , হার্ট ইত্যাদির সমস্যা আছে। এমনকি ক্যানসার আছে ক্যামোথেরাপি নিচ্ছে- এরা ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তাদের ক্ষেত্রে এগুলো মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন মৃত্যুটা প্রায় কাছাকাছি চলে আসে।
এগুলোর জন্য এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। সে জন্য জটিলতা শুরুর আগেই চিকিৎসা করা উচিত।
প্রশ্ন : কী করার আছে এই ক্ষেত্রে?
উত্তর : নিয়ম হচ্ছে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রোফাইল এক্সিস বা চিকিৎসা নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ওসিটামেবিন নামের একটি ওষুধ আছে যা টেমিফ্লু নামে বাজারে পাওয়া যায় সেটি ৭৫ মিলিগ্রাম করে দিনে একবার খেয়ে নিতে হবে। সাত দিন খেতে হবে। তবে সেটা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই খেতে হবে।
আর যদি আক্রান্ত হয়েই যায় তবে ৭৫ মিলিগ্রাম দিনে দুবার পাঁচ দিন করে খেয়ে নিতে হবে। আর যদি এমন হয় আমাকে যেতেই হবে বাইরে। কোনোভাবেই এটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। তখন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভেকসিন নিলে সোয়াইনফ্লুর মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কমে যায়।
যেমন আমাদের ভারতের নায়িকা সোনাম কাপুর তিনি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও ভালো হয়ে গেছেন। সুতরাং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের ঠিক আছে এটাতে ভালো হওয়ার সম্ভবনাও তাদের বেশি।
প্রশ্ন : যদি ভেকসিনেশনের সুযোগ না থাকে এবং অন্য সোয়াইন ফ্লু আছে এ রকম জায়গায় যেতেই হয় তবে অন্য কোনো সতর্কতা অবলম্বনের সুযোগ আছে কী?
উত্তর : এ রকম জায়গায় গেলে মাস্ক ব্যবহার করা ভালো। রুমাল ব্যবহার না করে আমরা যদি টিস্যু ব্যবহার করি। এটাকে পুনরায় ব্যবহার করব না। এই সকর্ততা আক্রান্তদের জন্য। তবে যাদের ঝুঁকি অনেক বেশি তাদের কোথাও যেতে হলে টিকা নিয়ে যাওয়া উচিত। আক্রান্ত হতে পারে মনে করলে হাত ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। সোয়াইন ফ্লু হলে বারবার হাত-মুখ ধোয়ার অভ্যাস করা উচিত। লিকুইড সাবান যেগুলো বাজারে পাওয়া যায় সেগুলো অন্তত ২০ সেকেন্ড ব্যবহার করতে হবে। আরেকটা জিনিস পাওয়া যায় এলকোহোল বেইজ সেনিটাইজার। এই সেনিটাইজার ৩ এমএলের মতো হাতের মধ্যে নিয়ে ভালোভাবে এপিঠ ওপিঠ ভালোভাবে মেখে নেবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা শুকিয়ে না যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত মাখতে হবে। সেক্ষেত্রে ঝুঁকিটা কিছুটা কমে যায়।