মহৎ পেশার মানুষ
বোনের মৃত্যু দেখেই চিকিৎসক হন রেজাউল করীম কাজল

প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির রাত। চাপাই নবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রাম। বাচ্চা জন্মের পর অনেক রক্তক্ষরণ হচ্ছে একটি মেয়ের। বাড়ির সবাই প্রার্থনা করছিল মেয়েটির আরোগ্যের। এতই বৃষ্টি হচ্ছিল যে হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা ছিল না। বাড়ির লোকেরা ভাবছিল সকাল হতে হতে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। তবে যে সকাল এলো সেটি সকাল নয়। ভোরের আলো ফুটেছে বটে, তবে এই আলো সেই পরিবারটির জন্য অন্ধকারের। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা গেল মেয়েটি।
বোনের মৃত্যুতে ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে মেয়েটির ছোট ভাই। বোনের এমন মৃত্যু দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বড় হয়ে ডাক্তার হবে সে। মানুষের চিকিৎসা করবে।
যে ছেলেটির কথা বলছি তিনি বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও ধাত্রী বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করীম কাজল। গর্ভাবস্থায় জন্মগত ত্রুটি নির্ণয়ে যে ডিএনএ সংগ্রহ করতে হয়, বাংলাদেশে ২০১২ সালে তিনিই তা প্রথম চালু করেন। এনটিভি অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন তাঁর জীবনের গল্প।
আমাদের এলাকায় চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো ছিল না
আমার বাড়ি চাপাইনবাব গঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নে। সেখানে সুযোগ সুবিধা তেমন ছিল না। মানুষের অসুখ বিসুখ হলে চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তার ছিল না। একজন চিকিৎসক ছিলেন মইনুদ্দিন আহমেদ মন্টু। তাকে মানুষ খুব শ্রদ্ধা করত। রাত বিরাতে তিনি মোটরসাইকেলে চরে রোগী দেখতে আসতেন। তাঁকে টাকা দেওয়া হলে কোনোদিন টাকা দেখতেন না। দুই চার টাকা যাই দেওয়া হোক। আস্তে করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখতেন।
আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। আমরা আট ভাইবোন ছিলাম। অনেক বড় পরিবার। মধ্যবিত্তের টানাপড়েন। ছেলেবেলায় আমি পোকামাকড় খুব পছন্দ করতাম। সবসময় আমার হাতে কোনো না কোনো পোকামাকড় থাকত। স্কুলে গেলে শিক্ষক বলতেন, ‘দেখি তোমার হাতে কী আছে?’ দেখা যেত হাতে পোকা। আর সেটি হয়তো ততক্ষণে মরেও গেছে।
আমার ব্ড় ভাই সিরাজুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর কুমিল্লা সেনানিবাস ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষক হোন। এখন এখানের ভাইস প্রিন্সপাল তিনি। তাঁর কাছে থাকতাম। ওখান থেকে এস এসসি, এইচ এসসি পাস করি। ১৯৮৮ সালে এসএসসি, ১৯৯০ সালে এইচএসসি পাস করি। এর পর বুয়েটে পরীক্ষা দেই। পাশাপাশি মেডিকেলেও। রাজশাহী মেডিক্যালে চান্স পাই। সেখানেই ভর্তি হই।
মেডিকেলে ঢোকার পর প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণে অনেক মা মারা যেত। হাসপাতালে আমি ঘুরে ঘুরে তাদের দেখতাম। জিজ্ঞেস করতাম রক্ত লাগবে কি না, প্রয়োজনে রক্ত দিতাম। তখন সন্ধানীর সদস্য হলাম। নিয়মিত রক্তদান কর্মসূচি করতাম। এ ছাড়া থেলাসেমিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চারা আসত। তাদের রক্ত দিতাম।
১৯৯৮ সালে ইন্টার্ন শেষ করে ঢাকায় চলে আসি বিসিএস দেই। তবে ১৯৯৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেই। প্রথম দুই বছর মেডিসিন বিভাগে ছিলাম। ২০০৫ সালে এফসিপিএস পাস করি। এক চান্সে পাস করি। আমার জীবনে কোনো ফেইল নেই। তখন ৩১ বছর। আমি ছিলাম সবচেয়ে কম বয়সী এফসিপিএস ডিগ্রিধারী। তখন থেকেই প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিষয়ে কাজ করা শুরু করি। সেই থেকে পদোন্নতি পেতে পেতে এখন সহযোগী অধ্যাপক। আমি যা কাজ শিখেছি সেটি অধ্যাপক ডা. আনোয়ার হোসেনের কাছে।
নারী রোগীরা প্রথমে আসতে চাইত না। আসলে নারী রোগীরা বুঝাতে চাইত পুরুষ চিকিৎসকের আচরণ মার্জিত কি না এবং তিনি ভালো চিকিৎসা দিচ্ছেন কি না। এগুলোর সদুত্তর পেলেই নারীরা চিকিৎসকের কাছে আসত। প্রসূতি ও গাইনি বিভাগের পুরুষ চিকিৎসকদের ভাষা অত্যন্ত মার্জিত, শব্দ-বাচনভঙ্গী ভালো হতে হয়। এতে রোগীদের কাছে বিশ্বস্ত হওয়া যায়। একজন রোগীর কাছ থেকে আরেকজন রোগী সেই চিকিৎসক সম্বন্ধে জানে। এভাবেই রোগীরা এ বিষয়ে পুরুষ চিকিৎসকদের কাছে আসতে আগ্রহী হয়। আসলে উন্নত বিশ্বে পুরুষ চিকিৎসকরাই এই চিকিৎসা করেন।
আবার বন্ধ্যাত্ব রোগের অর্ধেক কারণ পুরুষ। পুরুষ রোগীরা নারী চিকিৎসকের কাছে বলতে সংকোচ বোধ করে। তারাও পুরুষ চিকিৎসকের কাছে আসে।
দোকানে ধার করে চলতে হয়েছে
আমার বড় ভাই সংসারের খরচ চালাতেন। সে সময় শিক্ষকরা অনেক কষ্ট করে জীবন যাপন করতেন। দুই তিন মাস পরপর হয় তো বেতন পেতেন। দোকানে বাকি করেও খেতে হয়েছে আমাদের। ঢাকায় আসার পর অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তবে এখন সবাই স্বচ্ছল।
নতুন স্ত্রীকে ঠিকমতো সময়ই দিতে পারিনি
তখন আমি সদ্য বিবাহিত। আমার স্ত্রী তখন ইন্টার্নি করত। বিয়ের দুই দিন পর সে ইন্টার্নি করতে চলে যায়। তিন মাস পরে ঢাকায় আসে। কিন্তু যখন সে এসেছে, আমি এতই ব্যস্ত ছিলাম যে তাকে সময়ই দিতে পারিনি। বোঝেন অবস্থা (হাসি), সে সময় একজন রোগী ভর্তি হয়।খুব রক্তপাত হচ্ছিল তার। ২৪ ঘণ্টায় ১৭ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে।
সেই সময় তিনদিন হাসপাতালে ছিলাম। এমন অবস্থা যে আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলারও সময় নেই। সেই রোগীকে শেষ পর্যন্ত ২৭ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। রোগীটি এখন ভালো আছে। আমার এবং আমার পরিবারের লোকেদের সঙ্গে তার এখন বেশ ভালো সম্পর্ক।
আমি গান শুনতে বেশ ভালোবাসি। মান্না দের গান শুনি। আর বাঁশি বাজানো আমার খুব প্রিয় শখ। আমার দুই ছেলে। স্ত্রী সায়মা আক্তার চৌধুরী। সে রেডিওলজিস্ট। সরকারি হোমিও প্যাথি হাসপাতালে কর্মরত রয়েছে।
যেমন শিক্ষক আমরা পেয়েছি, তেমন শিক্ষক হতে পারিনি
যত দূর এসেছি, নিজেকে সফল মনে করি। তবে একটা বিষয়ে নিজেকে কিছুটা ব্যর্থ মনে হয়। আমরা যেমন শিক্ষক পেয়েছি, তেমন শিক্ষক নিজেরা হতে পারিনি। ছাত্ররাও আর আগের মতো নেই। এখন অনেকের মধ্যেই কত দ্রুত টাকা উপার্জন করবে, গাড়ি-বাড়ি করবে এই চিন্তা থাকে।
অর্থ উপার্জন মুখ্য বিষয় নয়
চিকিৎসা মহান পেশা। আমরা একটা সময় চিন্তা করতাম কাজ করলে টাকা এমনিতেই আসবে। তবে এখন বিষয়টি আর তেমন নেই। এই পেশায় অনেকে আসে অর্থ উপার্জন করার জন্য। আসলে অর্থ উপার্জন মুখ্য বিষয় নয়, গৌন বিষয় হওয়া উচিত।
নতুন যারা এই পেশায় আসছে তাদের খুব বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। পেশার প্রতি আন্তরিকতা ও সেবার মনোভাব থাকতে হবে। পেশাটা কতটুকু তার জন্য প্রজোয্য সেটা বোঝা প্রয়োজন। এই পেশায় স্নাতোকোত্তর করে পড়ালেখা করা কঠিন। এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশাও বটে। কারণ, মানুষের শরীর নিয়ে কাজ করতে হয়। তাই এই পেশায় আসার আগে অবশ্যই বুঝেশুনে আসতে হবে।
যতটুকু জানি তার সম্পূর্ণই শিক্ষার্থীদের শেখাতে চাই
মানুষ যদি অনু্ভব না করে, নাম শোনার পর ভালো অনুভূতি না হয়, এই জীবন বৃথা। এমন মানুষ হতে হবে যেন অন্য একজন মানুষ তার মতো হতে চায়। আমি চাই আমার ছাত্রছাত্রীদের এই বিদ্যায় প্রশিক্ষণ দিতে। আমি যা জানি তার সবটুকুই তাদের শিখাতে চাই।