মহৎ পেশার মানুষ
সফল মনোচিকিৎসক হেদায়েতুল ইসলাম

ছোটবেলা থেকে বহির্মুখী স্বভাবের ছিল ছেলেটি। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি তার মায়ের কাছেই। তখন নিয়ম অনুযায়ী ধর্মশিক্ষার ওপরে জোর দেওয়া হতো। একবার মায়ের কাছে কোরআন শরিফ পড়ছে। মা কোরআন শরিফের পাঁচটি আয়াত পড়তে দিয়ে একটু ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই ফাঁকে বন্ধুরা ডাক দেয় ছেলেটিকে। ইশারা পেয়ে ছেলেটিও চম্পট। পড়াশোনার কথা বেমালুম ভুলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় মত্ত হয়ে পড়ে সে। কিছুক্ষণ বাদে মা বুঝতে পেরে খুব রেগে যান। রেগে গিয়ে শাস্তি হিসেবে বাইরের উঠোনে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এরপর মায়ের ওপর এত অভিমান হলো যে সারা দিন গোয়ালঘরের মাচার মধ্যে পালিয়ে ছিল ছেলেটি।
কিছুক্ষণ পর আর যখন বাড়ির লোকেরা খুঁজে পাচ্ছিল না তাকে, তখন সবাই চিন্তায় পড়ে যায়। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে লোক পাঠায়, পুকুরে দেখে পড়ে গিয়ে মরে আছে কি না। পরে দিনশেষে সন্ধ্যায় গোয়ালঘরে গরু বাঁধতে গিয়ে দেখে সেখানে লুকিয়ে আছে সে। ভীষণ অভিমান হয়েছিল সেদিন মায়ের ওপর। আর বাড়ির লোকেরাও এত ভয় পেয়েছিল যে এরপর আর কোনো দিন কেউ শাস্তি দেয়নি তাকে।
যার কথা বলছি তিনি অধ্যাপক ডা. হেদায়েতুল ইসলাম। মনোরোগ চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ দেশের একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব তিনি। বাংলাদেশে মনোরোগ চিকিৎসায় এক বিশাল নাম।
১৯৮৭ সালে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল কংগ্রেস অব মেন্টাল হেলথ সভায় বাংলাদেশের মানসিক চিকিৎসায় অসাধারণ ভূমিকা পালনের জন্য লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। সদা অমায়িক, সুহৃদ, শান্ত ৮১ বছর বয়সের এই মানুষটি এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছে তাঁর জীবনের গল্প।
ছেলেবেলা
আমার জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, বর্তমান শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ থানার চরকুমারিয়া গ্রামে, নানার বাড়িতে। আমাদের বাড়ি ছিল সুখীপুর আরশিনগর ইউনিয়নে। নদীভাঙনের কারণে ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার বাড়ি স্থানান্তরিত হয় আমাদের। শৈশব কেটেছে গ্রামে, আর কৈশোর কেটেছে ফরিদপুর শহরে। চার ভাই ও তিন বোন ছিলাম আমরা। তবে এক বোন মারা গেছেন। আমি সবার বড়। আমার ছোট ভাই নজরুল ইসলাম ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। এরপরের ভাই মঞ্জুরুল ইসলাম কার্তিকপুরের ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে কাজ করেছেন। আমার ছোট বোন ফারজানা ইসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নির্বাচিত ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
ফরিদপুর হাইস্কুলে পড়ালেখা করেছি আমি। পরে রজনীকান্ত হাইস্কুল থেকে ১৯৫১ সালে এসএসসি পাস করি। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি ১৯৫৩ সালে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে এমবিবিএস পাস করি।
মেডিসিনে আর পড়া হলো না
ডাক্তারি জীবনের প্রথমে ইচ্ছা ছিল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হওয়ার। তবুও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ প্রথম থেকে ছিল। এই নিয়ে পড়াশোনা করতাম। পড়াশোনা করতে গিয়ে মানুষের মনের বিষয়ে আগ্রহ বোধ করি। জীবাণুঘটিত অসুখের বাইরেও মনোজগতের মানুষের নানা রকম অসুখ হয়। নানা ধরনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলে মানুষের মানসিক রোগের প্রভাব মনোজগতের ওপর পড়ে। অনেক সময় দৈহিক রোগের ভোগান্তি মানসিক কারণে বেড়ে যায়। অন্যদিকে মানসিক রোগের কার্যক্রম দেহের ওপর পড়ে।
১৯৬১ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে অবৈতনিক হাউস ফিজিশিয়ানের ব্যবস্থা ছিল। আমি সেখানে কাজ করার সময় একজন রোগী ভর্তি হন। যিনি কখনো কথা বলতেন না, হাঁটতেন না, কোনো কাজকর্ম করতেন না। অথচ কয়েক মাস আগেও রোগীদের নার্সিং সিস্টার হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি। তাঁর রোগ পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গেল যে সম্পূর্ণ বিষয়টি ছিল মনোদৈহিক কারণে। অর্থাৎ জীবনের চাপযুক্ত অবস্থার কারণে দৈহিক সমস্যাগুলো উপসর্গ হিসেবে প্রকাশ পায়। এই ঘটনাটি আমাকে বেশ প্রভাবিত করে।
পিএসসিতে পাস করার পর আমার প্রথমে পোস্টিং হয় পাবনা মানসিক হাসপাতালে। যদিও আমার মেডিসিন বিষয়ে খুবই ভালো নম্বর ছিল। পাবনায় থাকতে চাইছিলাম না। সে জন্য তখনকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার হায়দারের সঙ্গে দেখা করে জানাই মেডিসিনে পড়ার ইচ্ছার কথা। মেডিসিনে পোস্টিংয়ের জন্য অনুরোধ জানাই। কিন্তু তখন পাবনা মানসিক হাসপাতালে প্রশাসনিক কিছু সমস্যা থাকার কারণে সেখানে অতিরিক্ত চিকিৎসক হিসেবে পোস্টিং দেয়, তিন মাসের জন্য। এরপর তিন মাস পর চট্টগ্রাম মেডিকেলে পোস্টিং দিয়েছিলেন আমাকে। তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন। তবে মেডিসিনের জন্য আগ্রহ থাকার পরও এই তিন মাসে পাবনায় আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম মানসিক রোগের চিকিৎসা আমাদের দেশে ভীষণ অবহেলিত এবং খুবই খারাপ অবস্থা। তখন একজন মাত্র মনোচিকিৎসক ছিলেন এ দেশে, অধ্যাপক নাজিমুদ্দৌলা চৌধুরী। তিনি উৎসাহ দিলেন। বললেন, এই পেশায় থাকলে ভালো করবেন এবং ভবিষ্যতে স্কলারশিপের সম্ভাবনা আছে। তখন পাকিস্তান আমলে স্কলারশিপ সীমিত ছিল। পরে এসব কথা চিন্তা করে চট্টগ্রামে না গিয়ে পাবনায় থেকে গেলাম।
কর্মজীবন
পাবনা হাসপাতাল থেকে স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডনে চলে যাই। ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে তিন বছরের স্কলারশিপ পাই। তবে দেড় বছরেই কোর্স শেষ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য লন্ডনে বিভিন্ন হাসপাতালে প্রশিক্ষণ নিই এবং চাকরি পেতে থাকি। তখন লন্ডনে ভালো জায়গায় চাকরি পাওয়া কঠিন ছিল। পরে মডেল সোর্স নর্থ মিডেলসেক্স হাসপাতালে চাকরি পাই।
দেশে আসার পর স্বল্পকালীন ময়মনসিংহ হাসপাতালে যোগদান করি। এরপর তিন মাস পরে পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জ্যেষ্ঠ পরামর্শক হিসেবে যোগ দিই। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় হাসপাতালের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
১৯৭৭ থেকে সলিমুল্লাহ মেডিকেল প্রথমে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে যোগ দিই। এরপর ১৯৮১-এর ফেব্রুয়ারি থেকে অরগানাইজেশন অব ট্রেনিং ইন মেন্টাল হেলথের ডাইরেক্টর কাম প্রফেসর সাইকিয়াট্রি হই। ১৯৮৮ সালে মিটফোর্ড হাসপাতালে থাকার সময় প্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরণ করা হয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড রিসার্চ (আইএমএইচএআর) হিসেবে। এরপর ১৯৯০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তর করা হয়। তখন ঢাকা মেডিকেল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড রিসার্চে যোগ দিই। প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তীকালে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হয়।
বর্তমানে ঢাকা মনোরোগ ক্লিনিক এবং ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি মেন্টাল হেলথের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এবং এখানের প্র্যাকটিস করছি।
জীবনকে সার্থক মনে করি
নিজের জীবনকে সার্থক বলে মনে করি। তবে এই সার্থকতা পেতে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়েছি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট নির্মাণের সময় প্রথমে অরগানাইজেশন অব মেন্টাল হেলথ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালে। একটি উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে। পরে একে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট করার চিন্তা করা হয়। এ সময় প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক বাধা আসে। যদিও প্রথমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ঢাকায় করার অনুমোদন হয়। তবে পরে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। তখন অনেকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ইনস্টিটিউট করার পক্ষে ছিল। তবে পরবর্তীকালে সব বাধা অতিক্রম করে ঢাকার শেরে বাংলানগরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
কর্মজীবনে সুখী এবং তৃপ্ত আমি। অনেক রোগীকেই বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছি। আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে। সবাই চিকিৎসক।
যেহেতু সন্তানরা সবাই চিকিৎসক তাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে একটি নন প্রফিট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার। শরিয়তপুরে শিক্ষা ট্রাস্টের মাধ্যমে কাজ করছি। এ ছাড়া শরীয়তপুরে ব্যক্তিগতভাবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ দিই। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে আমার। ছবি তুলতে ভালোবাসি। ছাত্রদেরও পড়াতে ভালো লাগে।
সেবা দিলে টাকা এমনিই আসে
রোগীদের সেবা দিতে পারলে টাকার পেছনে দৌড়াতে হয় না। টাকা এমনিতেই আসবে এটা আমার বিশ্বাস। মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে বিনিময়ে কিছু না পেলেও সার্থকতা আছে। মানুষের শুভকামনা একটি বড় পাওয়া। রোগীরা যখন বলে দীর্ঘায়ু হোন এটি সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে মনে হয় জীবনে।