পেটের ওপরের অংশে ব্যথা
বিভিন্ন কারণে পেটের ওপরের অংশে ব্যথা হতে পারে। তবে এর জন্য সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। আজ ১৭ এপ্রিল এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০০৮ পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ইবনে সিনা হাসপাতালের লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহবুব রহমান।
প্রশ্ন : পেটের উপরিভাগে ব্যথা বা আপার এবডোমিনাল পেইন কী?
উত্তর : আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো অঙ্গ পেটের মধ্যে থাকে। তার মধ্যে নাভির উপরিভাগকে ওপরের অংশ বলে থাকি। লিভার, পিত্তথলি, পিত্তনালি, পাকস্থলী—এ রকম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো ওপরের অংশে থাকে। রোগীরা হয়তো পেটের নিচে বা তলপেটে ব্যথা হলে গুরুত্ব দেন। ওপরের অংশের ব্যথাকে গুরুত্ব দেন না। তবে পেটের এসব অংশও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : সাধারণত কোন কোন কারণে পেটের উপরিভাগে ব্যথা হয়?
উত্তর : পেটের উপরিভাগে ব্যথা হওয়ার সবচেয়ে প্রচলিত কারণ হলো পেপটিক আলসার রোগ। এ ছাড়া কারো যদি পিত্তথলিতে পাথর হয়ে প্রদাহ হয়, পিত্তনালিতে যদি কারো পাথর হয়, লিভারে যদি কারো ফোড়া অথবা পুঁজ হয়, যাকে লিভার এপসিস বলি—এসব সমস্যা হলে ব্যথা হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অগ্নাশয়ে যদি প্রদাহ হয়, সেটাকে আমরা পেনক্রিয়েটাইটিস বলি। এগুলো হলো পেটের অঙ্গের কারণে পেটের উপরিভাগে ব্যথা। কিন্তু এ ছাড়া দুটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ আছে, যেগুলো পেটের অঙ্গ নয়, তবে ব্যথা পেটের উপরিভাগেই হয়। যেমন—কারো যদি হার্ট অ্যাটাক হয়, তাঁর নাভির উপরিভাগে ব্যথার অনুভূতি হতে পারে। এ ছাড়া কারো যদি ফুসফুসের নিচের ভাগে ডান অথবা বাঁয়ে নিউমোনিয়া হয়, সেই রোগীরও পেটের উপরিভাগে ব্যথা হয়।
প্রশ্ন : ব্যথার ধরন দেখে বোঝার উপায় আছে কি না যে কী কারণে ব্যথা হচ্ছে?
উত্তর : উদাহরণ দিয়ে বলি, কারো যদি পেপটিক আলসার হয়, তার খালি পেটে ব্যথা বেশি হয়। ডিওডেনাল আলসার বা পেপটিক আলসার মানেই খালি পেটে ব্যথা হবে। খেলে ব্যথা কমে যাবে। আর গ্যাস্ট্রিক আলসারে খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা হবে এবং এটি দীর্ঘদিন ধরে থাকবে। এই রোগীরা সাধারণত নিজেরাই গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ কিনে খান। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকে। এই রোগীদের কখনো কখনো রক্তবমি হয়। ওজন কমে যেতে পারে। খাবার অরুচি হয়, কারো যদি পিত্তথলির পাথর বা পেটের প্রদাহ হয়, সে ক্ষেত্রে পেটের উপরিভাগে এবং ডান পাশে ব্যথা হয়ে থাকে। সাধারণত পেছনের দিকে এবং ডান কাঁধের দিকে ব্যথা সরে যেতে থাকে। এ সমস্যা সাধারণত নারীদের বেশি হয় এবং একটু স্থূল যাঁরা, তাঁদের বেশি হয়। আর অগ্নাশয়ের যেই ব্যথা, সেটি পেটের উপরিভাগে হয়, প্রচণ্ড ব্যথা থাকে। সঙ্গে বমি থাকতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত পিঠের দিকে সরে যায়।
আর যদি ফুসফুস বা হার্টের কোনো রোগের কারণে ব্যথা হয়, সে ক্ষেত্রে ব্যথার সঙ্গে যে বিষয়টি খেয়াল করতে হবে তা হলো রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কি না, রোগী ঘেমে যাচ্ছে কি না অথবা তাঁর শুয়ে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে কি না। অথবা তাঁর আগে হার্টের রোগ ছিল কি না, তখন তাঁকে সেভাবে চিকিৎসা দিতে হবে।
প্রশ্ন : যখন একটি রোগী ব্যথা অনুভব করে এবং নিজে নিজেই ওষুধ খেয়ে নিচ্ছেন, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী হবে?
উত্তর : আপনার পেটের উপরিভাগে হয়তো ব্যথা হচ্ছে, আপনি নিজে ঠিক করে নিলেন পেপটিক আলসার এবং সে অনুযায়ী ওষুধ খেয়ে নিলেন। সেটা নাও হতে পারে। পেটের ব্যথা মানেই আলসারের ব্যথা, এ ধারণা করা ঠিক নয়। জানতে হবে ব্যথার উৎস কোথায়, কোন অঙ্গ থেকে ব্যথাটি হচ্ছে এবং রোগটি কী। এর পর আপনাকে ওষুধ খেতে হবে। অধিকাংশ রোগী পেপটিক আলসারের ওষুধ খেয়ে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, তাঁর পেপটিক আলসার নয়। তাঁর হয়তো পিত্তখলিতে পাথর হচ্ছে। এই ওষুধগুলো আর তাঁর কাজে দিচ্ছে না। এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা এমনও দেখেছি, পিত্তথলিতে বছরের পর বছর পাথর আছে। একসময় পিত্তথলিতে ক্যানসার হয়ে গেছে। অথচ সে হয়তো অনেক দিন ধরে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে যাচ্ছে। তাই জানতে হবে, পেটে ব্যথা কেন হচ্ছে? সেটা যদি বারবার হয়, তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে হবে।
পেপটিক আলসারের জন্যও যদি ওষুধ খেতে থাকে, এই রোগীদের একসময় রক্তক্ষরণ হতে পারে। অনেক সময় যেসব জায়গায় আলসার হয়েছে, সেসব জায়গা সরু হয়ে যায়। সরু হয়ে গেলে রোগী খেতে পারে না, বমি হয়। পেপটিক আলসার হলেও এ জাতীয় ওষুধগুলো কাজ করে না। এর জন্য নির্দিষ্ট ধরনের ডোজ এবং নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত খেতে হবে। কারণ, রোগীরা কয়েক দিন খাওয়া বন্ধ করে দেন। জানেন না, কত দিন খেতে হবে। এর ফলে আলসার সম্পূর্ণ ভালো হয় না। একসময় অস্ত্রোপচার না করলে তাঁকে স্বাভাবিক খাবারদাবার দেওয়া যায় না।
প্রশ্ন : খাবারের সঙ্গে গ্যাস্ট্রিক বা পেপটিক আলসার রোগের সম্পর্ক রয়েছে কি?
উত্তর : অবশ্যই রয়েছে। খাবারদাবার এবং মেডিসিন দুটোর সঙ্গেই এ সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যে ধরনের ঝালযুক্ত খাবার খাই, এর ফলে এ ধরনের সমস্যা হয়। আরেকটি বিষয় রয়েছে ধূমপান করা। ধূমপানের সঙ্গে পেপটিক আলসারের সরাসরি সম্পর্ক। কেউ যদি ধূমপান করতে থাকে, সে অনেক ওষুধ খাওয়ার পর তাঁর আলসার সেরে যাবে না। তাঁর জটিলতা বাড়তেই থাকবে। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের দেহের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথার কারণে আমরা ব্যথার ওষুধ খেয়ে থাকি। সেই ব্যথার ওষুধ কীভাবে খেতে হবে, কী নিয়মে খেতে হবে, তার সঙ্গে অন্য ওষুধ খেতে হবে কি না সেটি অনেকেই জানেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস বন্ধ করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নির্দিষ্ট রোগ নির্ণয় করে তার সঠিক চিকিৎসা করা হলে তবেই রোগীরা ভালো ফল পাবেন।