বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস
মানসিক স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা নয়
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/10/10/photo-1476101425.jpg)
আজ ১০ অক্টোবর, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৫২২ দিবসটি নিয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. শামসুল আহসান। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের এবারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কী?
উত্তর : প্রতিবছর ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হয়। এই বছরের প্রতিপাদ্য হলো সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড ফল অল। সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড বলতে আমরা যেটা বুঝি, সাম্প্রতিক সময়ে যেই সহিংসতা দেখছি, বিভিন্ন ধরনের যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়, তখন একজন ব্যক্তির বিভিন্ন রকম মানসিক ও শারীরিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অনেকটাই উপেক্ষিত থাকে। এই জন্যই এই বছরের প্রতিপাদ্য হলো সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড।
প্রশ্ন : সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড মানে কী? আমরা যেমন ফাস্ট এইড বলতে প্রাথমিক চিকিৎসা বুঝি- এখানে বিষয়টিকে কী বোঝানো হয়ে থাকে?
উত্তর : এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধরেন একজন ব্যক্তি কোনো সহিংসতার শিকার হলো, যেমন বলতে পারি সাম্প্রতিককালে যে হলি আর্টিজানে একটি ঘটনা হলো, যারা সার্বিকভাবে আহত বা বিভিন্ন মারাত্মক জখমের শিকার হয়েছে, ওটা নিয়ে আমরা অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলাম। একটি সহিংসতার ঘটনায় একজন ব্যক্তি যে মানসিকভাবে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যেতে পারে, এই ব্যক্তি যদি হাসপাতালে জরুরি অবস্থায় যান, তার সার্বিক চিকিৎসা যতটা করা হচ্ছে, মানসিক চিকিৎসা কিন্তু অতটা করা হচ্ছে না। কিন্তু এই বিপর্যয়ের কারণে তার যে সামাজিক ইনটিগ্রেশন সবার সঙ্গে, প্রতিদিন যেসব কাজ সে করে, অফিসে যায়, বিভিন্ন রকম কাজকর্ম করে, এসব বিষয়গুলো থেকে সে কিন্তু অনেকটা গুটিয়ে নিয়ে আসছে। সবার চোখেও ধরা পড়ে না। একটা সময় গিয়ে ধরা পড়ে- এ জন্যই হয়তো উপেক্ষিত থাকছে। তার যে মানসিক একটি পুনর্বাসন দরকার, তার যে মানসিক একটি সমস্যা হচ্ছে, একটি পরিচর্যার দরকার, এটাকে আসলে হাইলাইট করে। তাকে মূলত সাহায্য করা, যে যে প্রয়োজন সেগুলোকে পরামর্শ দেওয়া।
প্রশ্ন : সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড ফর অল- বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর : শিশু, বয়োসন্ধি, প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেকেরই মানসিক সমস্যার কারণে তার দরকার হতে পারে। এটা আসলে একটি সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা। এটা শুধু যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাই দেবেন সেটি নয়, যাঁরা এই দলে কাজ করেন, তাঁদের প্রত্যেকেই এটা দিতে পারেন। সবারই যে সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড দরকার হবে, সেটি কিন্তু নয়। আমরা মূলত এই জিনিসটিকে অ্যাপ্রোচ করব। এবং যাদের যাদের দরকার এই জিনিসটি দেওয়া হবে। মনোরোগ চিকিৎসার জন্য আমরা তো সাধারণত মনোরোগ হাসপাতাল, বা একটি জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে মনোরোগ যে ইউনিট আছে সেখানে গিয়ে এই চিকিৎসাটা দিয়ে থাকি। এটার উপজীব্য হচ্ছে যে মেন্টাল হেলথ টিম থাকবে, তাদের যেন এ রকম একটি বিশেষজ্ঞ থাকে যে তারা জরুরি অবস্থায় যে মানসিক সমস্যাগ্রস্ত রোগীরা যান, ওখানে যেন একটি চিকিৎসাব্যবস্থা থাকে। যাতে প্রথমে গিয়ে এই চিকিৎসা সুবিধাটা তারা পায়।
প্রশ্ন : বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে আপনাদের আজকের কর্মসূচি কী?
উত্তর : মানসিক স্বাস্থ্য তো একটি সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা। এই বিষয়টিকে হাইলাইট করা যে সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড কারো কারো দরকার হতে পারে। এ জন্য ধরেন যাঁরা এই দলে কাজ করবেন, তাঁরা যেন এই জরুরি সেবা পেতে পারেন। কিছু দিন আগে যখন সিডর হয়েছিল, দেখা যায় অনেক লোকই হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে পারেন না। নানা রকম সমস্যার কারণে তাঁরা এলাকায় থেকে যান এবং সমস্যার মধ্যে ভোগেন। ওখানে গিয়ে তাঁদের প্রয়োজনটা দেখা, যদি তাঁদের সাইকোলজিক্যাল ইন্টারভেনশন দরকার হয় সেটি। মূলত সাহায্য করা। তাঁর সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থার মাধ্যমে তাঁর শারীরিক চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক চিকিৎসার যে উপকরণ দেওয়া প্রয়োজন এটা নির্ণয় করা।
প্রশ্ন : আপনারা কি এর জন্য কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন যাতে করে সাধারণ মানুষ বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে শারীরিক সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক সমস্যার যেই প্রাথমিক চিকিৎসা সেটা যাতে হয়?
উত্তর : আসলে বিশ্বব্যাপী যে সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে এবং এতে যে কারো এই সাহায্যের দরকার হচ্ছে, একে কিন্তু সচেতন করার জন্য এই বছরে উপজীব্য এটা।
আমাদের দেশে মানসিক চিকিৎসাব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল এবং অবহেলিত। আসলে যে পরিমাণ মানসিক চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন, সেটি আমরা দিতে পারছি না। এই দিবসের উপজীব্য হচ্ছে সচেতনতা বৃদ্ধি, দরকার হলে একটি উপযুক্ত দল তৈরি করে, সেই দলের মাধ্যমে ব্যবস্থাটা দেওয়া। চিকিৎসক ও জনসাধারণকে সচেতন করা। যেন এই জাতীয় বিপর্যয়ের শিকার যেই রোগীরা আছেন, তাঁদের জন্য যে সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড দেওয়া প্রয়োজন এবং কী কী ভাবে দিতে হয়, এই সম্বন্ধে তাদের যেন একটি সম্মক ধারণা থাকে। এই সচেতনতা বাড়ানোও আমাদের এই দিবসের অন্যতম লক্ষ্য।
সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড শুধু যে আমরা মানসিক রোগীদের দেব সেটি নয়। স্বাভাবিক ব্যক্তি, তার সব কিছু ঠিক ছিল, তবে হঠাৎ করে একটি অত্যন্ত বিপর্যয়কর ঘটনা, সহিংসতা বা তার জীবনে একটি অন্যতম পরিবর্তন চলে এসেছে, এ রকম পরিস্থিতিতে সে মানসিক রোগে বিপর্যস্ত হতে পারেন, মানসিক রোগী উনি নাও হতে পারেন। ওই ক্ষেত্রে তাঁকে উপযুক্ত সাহায্য করা, তাঁর প্রয়োজনগুলোকে এডজাস্ট করা। তাঁর শারীরিক বিপর্যয়গুলোকে চিহ্নিত করব, পাশাপাশি তাঁর মানসিক বিপর্যয়গুলোকে চিহ্নিত করব। যদি সাইকোথেরাপি দেওয়া হয়, তার অন্যান্য যেসব প্রয়োজন, সেগুলোকে যদি আমরা চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে হয়তো তিনি মানসিকভাবে ওভাবে রোগী না হওয়ার আশঙ্কা থেকে বাঁচতে পারেন। এবং তখন যেন সারভাইভ করতে পারেন।
প্রশ্ন : মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থা কেমন? এই বিষয়গুলোতে কাদের সচেতন করা জরুরি?
উত্তর : আসলে সচেতনতার জন্যই কিন্তু আজকের উপজীব্য বিষয়। বিশ্বব্যাপী যে আজকের দিনে এই বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষাপটে যে সহিংসতা হচ্ছে, বিভিন্ন দেশে আমরা যেমন দেখছি মারামারি-হানাহানি, সবার জন্যই কিন্তু এটা দরকার। বলব যে আমাদের দেশে এই বিষয়ে আরো সচেতনতার প্রয়োজন। এই জন্য একটি উপযুক্ত মানসিক স্বাস্থ্যদল দরকার। এই দলের সদস্য হিসেবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্কার সবার সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা দরকার।
২০০৭ সালে যখন সিডরে ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল বিপর্যস্ত হয়ে গেল, তখন সেখানে আমরা মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা সেখানে কতটুকু প্রয়োজন সেটা সমীক্ষা করার জন্য গিয়েছিলাম। যাঁরা বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য লোকের মধ্যে মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা গিয়েছে। যেমন পোস্ট ট্রমাট্রিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, সোশ্যাল ফোবিয়া, একিউট এংজাইটি ডিজঅর্ডার, একিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার- ওই সময়ে ওই বিষয়গুলো কিন্তু উপেক্ষিত ছিল। রানা প্লাজার ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই রকম।