শিশুদের সাধারণ সর্দি-কাশিতে করণীয়

শীতের শুরুতেই শিশুদের সাধারণ সর্দি কাশি হতে পারে। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৫৪৪তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. সুবাস চন্দ্র সাহা। বর্তমানে তিনি শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেলের শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : শীতে শুরুর দিকে কেন এই সমস্যা বেশি দেখা যায়?
উত্তর : সাধারণত প্রতিটি আবহাওয়াতেই বিশেষ বিশেষ অসুখ হয়ে থাকে। বিশেষ করে বাচ্চাদেরসহ বড় মানুষের ক্ষেত্রেও এই কথাটি প্রযোজ্য। তবে কিছু কিছু সময়ে কিছু কিছু রোগের প্রার্দুভাব হতে দেখা যায়। আমাদের দেশের সঙ্গে সারা বিশ্বেরই এর একটি প্রাদুর্ভাব আছে। সাধারণত যে শীতের আবহাওয়াটা আসে, হঠাৎ করে গরমের পর যখন শীত পড়া শুরু করে, তখন বাচ্চাদের বিশেষ করে ছোট ছোট বাচ্চাদের সমস্যা হয়।
পাঁচ বছরের নিচের বাচ্চাদের বিষয়ে কথা বলব। হঠাৎ করে যখন তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়, সেই তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের যে শারীরিক পরিবর্তনটা হয়, সঙ্গে সঙ্গে গরম থেকে ঠান্ডার এই বিষয়টা তারা সমন্বয় করতে পারে না। যার কারণে কিছু কিছু সমস্যা শীতের শুরুতে তৈরি হয়। এর অন্যতম হচ্ছে ঠান্ডা, সর্দি, কাশি। শিশুমৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ হলো নিউমোনিয়া। এটি ফুসফুসের একধরনের সংক্রমণ। নিউমোনিয়া যাতে না হয়, আর হলেই যেন তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা করা যায়, তারই প্রাথমিক লক্ষণ হলো ঠান্ডা সর্দি-কাশি।
নিউমোনিয়া খুব ছোট বয়স অথবা খুব বড় বয়সে হয়। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া হয় না। অর্থাৎ শরীরের যে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা পরিপূর্ণতা না পেলে তখন এই সংক্রমণটা হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে নবজাতক বা ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শরীরের রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের একটু সমস্যা হয়। বয়স্কদেরও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। এই কারণে এই দুটো বয়সে নিউমোনিয়া বা শ্বাসকষ্টের সংক্রমণ হয়। এর মৃত্যুহার খুব উঁচু। এ জন্য যদি আমরা আগের থেকে এর চিহ্নগুলো বা লক্ষণগুলো বুঝে সচেতনতা তৈরি করতে পারি, তাহলে যদি প্রাথমিকভাবে রোগনির্ণয় হয়, প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা দেওয়া হয়, ভালো ফলাফল পাব।
প্রশ্ন : ঠিক কী কী লক্ষণ দেখা দেবে?
উত্তর : প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে কাশি, শ্বাসকষ্ট। এখন অনেক সময় শ্বাসকষ্টটা মা ঠিকমতো বলতে পারেন না। মা হয়তো বলেন, দম ফেলতে পারছে না। সেই সঙ্গে কাশি হচ্ছে, সেই সঙ্গে নাক দিয়ে পানি পড়ছে, অথবা একটু হালকা জ্বর থাকতেও পারে, নাও পারে। মূলত যদি আমরা দুটো লক্ষণকে কেন্দ্র করি, একটি হচ্ছে কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়া, আর শ্বাসকষ্ট। শ্বাসকষ্টের ভিন্নতা হতে পারে। মা বুঝতে পারেন, তাঁর বাচ্চা আগে যেভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিত একটু হলেও তার পরিবর্তন হয়েছে। এই কারণেই তাঁরা সাধারণত চিকিৎসকের কাছে যান।
প্রশ্ন : অনেক সময় দেখা যায় শিশুর একটু ঠান্ডাজ্বরে নিজে থেকেই হয়তো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো শুরু করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
উত্তর : সাধারণ ঠান্ডা-সর্দি-কাশির একটি ব্যবস্থাপনা বিষয় আছে। আমি প্রথমেই উল্লেখ করেছি একটি অন্যতম শিশুমৃত্যুর কারণ হলো নিউমোনিয়া। আমাদের বাংলাদেশ সরকারই শুধু নয়, ডাব্লিউএইচওর প্রবর্তিত একটি প্রোটোকল আছে। আমরা একে বলি আইএমসিআই। এর মধ্যে নিউমোনিয়ার কথা বলা আছে, ডায়রিয়ার কথা বলা আছে। পুষ্টিহীনতা আছে। যেগুলো মোটামুটি শিশুমৃত্যুর কারণ। এ জন্য ওখানে একটি প্রোটোকল বা চার্ট রয়েছে। একটি নিউমোনিয়া বা একটি ঠান্ডা সর্দি-কাশির বাচ্চাকে আসলে কীভাবে চিকিৎসা করতে হবে, এর একটি চার্ট আছে। সেই চার্টের মাধ্যমে আমরা চিকিৎসক সমাজ তো বটেই, যারা আমাদের গ্রামে উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মী আছে, তাদের আমরা প্রশিক্ষণ দিই। কোনটির চিকিৎসা বাড়িতে করা যাবে, অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে, কোনটির জন্য রেফারেল লাগবে, কোনটার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কোন ক্ষেত্রে ভর্তি করে ইনজেকশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে। এর একটি সুনির্দিষ্ট প্রটোকল আছে। আমরা প্রথমেই বলেছি এটা সাধারণ ঠান্ডা সর্দি-কাশি। এই ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। অথচ এর যত্রতত্র ব্যবহার হচ্ছে। এখানে দুটো বিষয় হয়। যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াচ্ছি, যেখানে ইনজেকশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে, সেখানে আমি হয়তো মুখে খাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছি। এতে কোনো কাজই হচ্ছে না। চিকিৎসকরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী চিকিৎসা করে থাকেন। আর আমরা স্বাস্থ্যকর্মীদেরও এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিই। আমাদের কাছে এলে আমরা এর চিকিৎসা দিই।
প্রশ্ন : কীভাবে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব?
উত্তর : শীতের শুরু হলো, সাধারণত যেভাবে বাচ্চাকে রাখি এর থেকে একটু ভিন্নভাবে রাখতে হবে। তার জামাকাপড়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাকে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য কুসুম গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করাতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমি যদি একদম ছোট বাচ্চার কথা বলি, বুকের দুধ পান করাতে পারলে নিউমোনিয়াসহ যেকোনো সমস্যা কমে যাবে। সুতরাং মায়েদের কাছে অনুরোধ থাকবে তাদের বাচ্চাদের একটু গরম অবস্থায় রাখা, গরম কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা, এই গরম কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখার ক্ষেত্রেও মাকে নিজস্ব বুদ্ধি খাটাতে হবে। অল্প শীত, বেশি শীত- এটা বুঝতে হবে। শিশু ভেতরে হয়তো ঘেমে যাচ্ছে, তখন বুঝতে হবে ঘাম থেকে আবার ঠান্ডা লাগছে। এই জন্য তাদের কাউন্সেলিং করা, উপদেশ দেওয়া। শালদুধ খাওয়ানো থেকে আরম্ভ করে বুকের দুধ খাইয়ে যেতে হবে ছয় মাস পর্যন্ত। এটা করা। এবং বাচ্চাকে একটু গরম অবস্থার মধ্যে রাখা, গরম কাপড় দেওয়া এবং কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করানো বা অন্যান্য কাজগুলোর পরিচর্যা করা, এগুলো করলেই এই সমস্যাগুলো অনেক কমে আসবে।
প্রশ্ন : ছোট শিশু বা একটু বড় শিশুদের ক্ষেত্রে ঠান্ডা, শ্বাসকষ্টের লক্ষণগুলো কি একই থাকে?
উত্তর : না সেটি নয়। সাধারণ সর্দি কাশির যদি আনুষঙ্গিক কিছু লক্ষণ থেকে থাকে, তখন কিন্তু আর সাধারণ থাকবে না। তখন এটা নিউমোনিয়ার পর্যায়ে চলে যাবে। কোনোটা খুব মারাত্মক নিউমোনিয়া, আবার নিউমোনিয়া নয়, সেই ক্ষেত্রে আমরা কিছু প্যারামিটার ব্যবহার করি। ওই প্যারামিটারগুলো স্বাস্থ্যকর্মীসহ একজন সাধারণ মানুষের পক্ষেও বোঝা সম্ভব। যেমন একজনের ঠান্ডা সর্দি-কাশি আছে, আমরা বুঝতে পারছি। সেই সঙ্গে বাচ্চার যদি হঠাৎ করে খিঁচুনি হয়। সেই বাচ্চাটা যদি হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়ে, হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ে, নেতিয়ে পড়ে, বাচ্চা কিছুই খেতে পারছে না। খেতে গেলে বা খাওয়ার পর বমি করে দিচ্ছে। মা যদি দেখে বাচ্চা আগে যেভাবে শ্বাস নিত, এখন দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। অথবা আমরা দেখছি শ্বাস নেওয়ার সময় পেট উঁচু হয়। কিন্তু কোনো কারণে শ্বাস নেওয়ার সময় পেট বুকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। এগুলো হলে বুঝতে হবে মারাত্মক সমস্যা আছে। চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। এই সময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।