সাধারণ গাইনোকোলজিক্যাল সমস্যা ও তার প্রতিকার
কিশোরী থেকে প্রবীণ বয়স পর্যন্ত নারীর শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। আজ ২১ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৪২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের পরামর্শক ডা. ফারজানা ডালিয়া।
প্রশ্ন: সাধারণ গাইনোকোলজিক্যাল সমস্যা বলতে আমরা বুঝি একজন নারীর বিভিন্ন ধরনের গাইনোকোলজিক্যাল সমস্যা, যা নিয়মিতভাবেই হয়। এগুলো কখনো কখনো গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। আবার কোনো কোনোটি খুব সাধারণ আকারেই থেকে যায় বা ভালো হয়ে যায়। এ সমস্যাগুলো আসলে কী?
উত্তর : সাধারণত প্রাথমিকভাবে যে অভিযোগ নিয়ে রোগীরা আসেন, সেটি হলো মাসিকের সমস্যা। মাসিকের সমস্যা বেশ প্রচলিত। এটি ছোট বয়সের মেয়েদের থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী নারীরও হয়ে থাকে।
প্রশ্ন : ছোট বয়সের দিকে যদি একটু বলেন। মাসিক শুরুর দিকে মেয়েটির নানা ধরনের উৎকণ্ঠা থাকে। কী ধরনের অভিযোগ নিয়ে আসে তখন?
উত্তর : প্রথম দিকে দেখা যায় অভিযোগ নিয়ে আসে তার মাসিকের সময় প্রচণ্ড পেট ব্যথা হচ্ছে। তারপর কারো কারো খুব বেশি রক্তপাত হচ্ছে, কারো কম হচ্ছে। বেশি রক্তপাত হয়ে অনেক সময় রক্তশূন্যতা পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগ থাকে প্রথম দিকে। এ ছাড়া মধ্যবয়সীদের মধ্যেও আমরা এ ধরনের অভিযোগ পেয়ে থাকি। প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বা কারো তিন-চার মাস পরপর মাসিক হচ্ছে। আবার কারো হয়তো বা মাসে দুবার হয়ে যাচ্ছে। কারো স্বল্প পরিমাণে হচ্ছে। আর মাসিকের সময় পেটব্যথা খুব প্রচলিত। আমরা সারাক্ষণই এমন ধরনের রোগী পাই। ব্যথা এত তীব্র হয় যে ওষুধ খেয়েও সহ্য করার মতো থাকে না। এ ধরনের সমস্যা পেয়ে থাকি। এ ছাড়া টিউমারের সমস্যা পেয়ে থাকি। জরায়ুতে বিভিন্ন টিউমার হয়। ওভারিতে টিউমার হয়।urgentPhoto
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন প্রচুর পরিমাণ রক্তপাত হয়। বেশি রক্তপাত হলে সেটা নিয়েই সবাই আতঙ্কিত এবং চিন্তিত থাকে। কী পরিমাণ রক্তপাত হলে একে আপনি মাত্রাতিরিক্ত বলছেন এবং সমস্যা মনে করছেন?
উত্তর : প্রথম দিকে রক্তপাত যদি ৬০ বা ৮০ মিলিমিটারের বেশি হয়ে থাকে প্রতিদিন, সে ক্ষেত্রে আমরা বলব প্রচুর পরিমাণে রক্তপাত। একটা মাসিক চক্রের মধ্যে তার হয়তো অনেকগুলো প্যাড নিতে হচ্ছে। প্রথম দিকে হয়তো তিনটা প্যাড নিতে হয়, যদি বেশি রক্তপাত হয় তবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে তার হয়তো পাঁচ-ছয়টা প্যাড নিতে হয়। এটিকে আমরা প্রচুর পরিমাণ রক্তপাত হওয়া বলি। আর অল্প বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি সাধারণত হয়ে থাকে। কারণ তখন তাদের হরমোন ভারসাম্যহীন থাকে। সেই কারণে বেশি সমস্যা হয়ে থাকে। এ ছাড়া অনেকেরই হয়তো থাইরয়েডের সমস্যা হয়ে থাকে। পলিসস্টিক ওভারি রোগটিও অল্প বয়সী মেয়েদের হয়ে থাকে, এ কারণেও এই সমস্যা হতে পারে।
এ রকম হলে আমরা প্রথমেই তাদের পরামর্শ দিই। অনেকে অল্প পরিমাণ রক্ত যাচ্ছে তাকে অতিরিক্ত ভাবে। সেই ক্ষেত্রে আমরা জানতে চাই সে প্রতিদিন কয়টা প্যাড ব্যবহার করছে। সেই সব লক্ষণ দেখে যদি মনে হয় আসলে স্বাভাবিক ধরনের রক্তপাত তখন তাকে কাউন্সিলিং করে দিই।
প্রশ্ন : এই ক্ষেত্রে আপনি কি একটু বলবেন বেশি রক্ত যাওয়ার প্রচলিত কারণগুলো কী। কী কী সমস্যা অনুভব করলে তার অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?
উত্তর : যদি কোনো কারণই খুঁজে না পাওয়া যায় কিন্তু তার অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে, এমন হলে সেটা সাধারণত হরমোনাল অস্বাভাবিকতার জন্য হয়ে থাকে। এছাড়া যদি ফাইব্রোয়েড টিউমার হয়ে থাকে তার জন্যও হতে পারে। ওভারিয়ান টিউমারের জন্য হতে পারে, প্যালভিক ইনফ্লামেটোরি রোগ যদি হয়ে থাকে, সেই ক্ষেত্রে হতে পারে। এন্ড্রোমেট্রোসিস রোগের কারণেও অনেক সময় হয়ে থাকে। এ ছাড়া যদি হাইপার টেনশন থাকে সে ক্ষেত্রেও প্রচুর পরিমাণ হতে পারে। সিস্টেমিক অনেকগুলো রোগের জন্যও হয়। যদি কিডনি ফেইলিউর থাকে, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে সেই ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত রক্তপাত হতে পারে। আর যদি রক্তের সমস্যা থাকে, তবে তো অবশ্যই হয়ে থাকে।
প্রশ্ন : যদি দেখেন রোগীর বেশি রক্তপাত হচ্ছে তবে এটি কী কারণে হচ্ছে নির্ণয়ের জন্য কী করে থাকেন?
উত্তর : কী কারণে হয়েছে সেটি ধরেই আমরা সমাধানের পথে আগাই। যদি কোনো কারণই খুঁজে না পাওয়া যায়, এমনিতে আমরা যেটাকে ডিওভি ডিসফাংশন ব্লিডিং বলে থাকি এমন হলে আমরা প্রথমে পরামর্শের দিকে যেতে চাই। যদি কাজ না হয়, সেক্ষেত্রে রক্তপাত বন্ধ করে এমন কিছু ওষুধ দিয়ে থাকি। তারপরও কাজ না করলে হরমোনাল কিছু চিকিৎসা আছে সেগুলো দিয়ে থাকি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় হরমোনাল ভারসাম্যহীনতার কারণে এরকম হয়ে থাকে। আর এরপর যদি দেখা যায় থাইরয়েডের কোনো সমস্যার জন্য এটি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আমরা এর চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এ ছাড়া যদি সিস্টের জন্য হয়, চকলেট সিস্ট তখন সেই অনুযায়ী আমাদের হরমোনাল চিকিৎসা দিতে হয়। আর না হলে পরবর্তীকালে সিস্টটাকে আমরা সরিয়ে ফেলি। আর মধ্য বয়সে যদি ফাইব্রোয়েড ইউট্রাসের জন্য এই সমস্যা হয়ে থাকে বা জরায়ুর টিউমারের জন্য হয়ে থাকে তখন সেটাকে আমরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সমাধান খুঁজি।
প্রশ্ন: কিছু পদ্ধতিগত (সিস্টেমিক) সমস্যার কথা বলছিলেন সেই ক্ষেত্রে কী করেন?
উত্তর: যদি রক্তচাপ বেশি থাকে সেই ক্ষেত্রেও বেশি রক্তপাত হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আমরা তাকে একজন রক্তচাপ বিশেষজ্ঞ বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ করার পরামর্শ দিই। লিভারে যদি সমস্যা হয় সেই ক্ষেত্রে লিভার বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাই। যেন সে অনুযায়ী সে মেডিসিনটাকে গ্রহণ করে। এভাবে পদ্ধতিগত সমস্যা থাকলে আমরা অন্য চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে দিই। তখন কারণ ধরে চিকিৎসা করা হয়।
প্রশ্ন: এই ক্ষেত্রে যদি কেউ অবহেলা করে এবং ঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে না যায় তবে কতটা গুরুতর হতে পারে সমস্যাটি?
উত্তর : এতে দেখা যায় অনেক বেশি রক্তশূন্যতা চলে আসে। এনিমিক হয়ে পড়ে। যদি দেখা যায় শরীরে কম পরিমাণ রক্ত রয়েছে সেই ক্ষেত্রে এনিমিক হার্ট ফেইলিউর হতে পারে। তার অপুষ্টি হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে অবশ্যই তার জরুরিভাবে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন : আপনি শুরুতে তলপেটে ব্যথার কথা বলছিলেন, সেই ক্ষেত্রে করণীয় কী?
উত্তর : প্রথম দিকে যাদের মাসিক হয়, অল্প বয়সী মেয়েদেরই বেশি থাকে, এছাড়া আরেকটি রোগ চকলেটসিস্ট এটা হলেও প্রচণ্ড পরিমাণ ব্যথা হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আমরা কারণগুলোকে নির্ণয় করার চেষ্টা করি। তখন মাসিকের প্রথম সময়ে কিছু ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে দিই। অন্তত যেই দুদিন বা তিনদিন ব্যথা থাকে সে সময়টায় খাওয়ার জন্য বলি। অনেক সময় দেখা যায়, ইনফেকশনের জন্য ব্যথা হয়ে থাকে। সে কারণটি নির্ণয় করে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিই। আর যাঁরা বিবাহিত থাকেন, তাঁদের দ্রুত বাচ্চা নেওয়ার জন্য বলে থাকি।
প্রশ্ন : বিবাহিত যাদের এই সমস্যাটি হচ্ছে, তাদের জীবন-যাপনে কোনো পরিবর্তন করতে হয় কী?
উত্তর : খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে বলি। অনেক সময় দেখা যায় যদি ওজনটাও বেশি হয়ে যায় সেই ক্ষেত্রে মাসিকের সমস্যা তৈরি হতে পারে। অনেক সময় প্রচুর রক্তপাত হতে পারে। অনেক সময় দীর্ঘদিন মাসিক হতে পারে। এই ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই বলি তার ওজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ওজনটা যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে পাঁচ শতাংশ ক্ষেত্রে মাসিকের সমস্যাটি ঠিক হয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে ওষুধ লাগে না। ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা তাকে বলি শাকসবজি বেশি পরিমাণে খাওয়ার জন্য। নিয়মিতভাবে ব্যঁয়াম করার জন্য। যদি জীবন-যাপনের ধরনের পরিবর্তন করে, তবে মাসিকের জটিলতা অনেকখানি ঠিক হয়ে যায়।
প্রশ্ন: আরেকটি প্রচলিত সমস্যা বলছিলেন মাসিক অনিয়মিত হওয়া বা কম সময়ের ব্যবধানে হওয়া। এটি কেন হয় এবং তখন আপনারা এর ব্যবধানের জন্য কী করেন?
উত্তর : অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে মাসিকচক্রটা কম থাকে। ২৮ দিনেরটা ২১ দিনে থাকে। ২১ দিনের মাথায় যদি হয় তখন অনেকে ভাবেন যে এটার হয়তো বেশি মাসিক হলো। এটা কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু যদি একমাসের মধ্যেই ২১ দিনের আগে যদি হয়, দুবার যদি হয় অথবা দেরি হচ্ছে সেই ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে কী কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। দেখি তার ওজনটা কেমন, পলিসিস্টিক ওভারি রোগটি আছে কি না। সেটা হলেও এ ধরনের সমস্যা থাকে। আবার যদি ইনফেকশন থাকে, পেলভিক ইনফ্লামেটোরি রোগ থাকে সেই ক্ষেত্রেও এই ধরনের সমস্যা হতে পারে। আবার যদি উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা থাকে সেই ক্ষেত্রেও অনেক সময় এই সমস্যা হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে কারণ নির্ধারণ করে সমাধান করা হয়।