বাইপাস সার্জারি কখন দরকার
বাইপাস সার্জরি একটি খুব সাধারণ বিষয় বর্তমান সময়ে। হার্টের ব্লক দূর করার জন্য এই সার্জারি করা হয়। আজ ২৬ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৪৭ তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন এনআইসিভিডির কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ কে এম মঞ্জুরুল আলম।
প্রশ্ন : বাইপাস সার্জারি কী এবং এটি কখন দরকার হয়?
উত্তর : যদি কোনো রোগীর এনজিওগ্রাম করার পর তার রক্তনালিতে ব্লক ধরা পড়ে, সাধারণত তখনই আমরা বাইপাস সার্জারি করি। যেসব রোগীকে স্ট্যান্টিং বা রিং লাগানো যায় না, কিংবা রক্তনালিতে যে পরিমাণ ব্লক আছে সেটি দিয়ে হয়তো কাজ হয় না সেসব রোগীর ক্ষেত্রে আমরা বাইপাস করি। অথবা কোনো কোনো রক্তনালিতে ১০০ শতাংশ ব্লক থাকে। যেগুলোতে হয়তো স্ট্যান্ট করা যায় না সেই ক্ষেত্রে আমরা বাইপাস সার্জারির পরামর্শ দেই।
প্রশ্ন : এই পরামর্শগুলো যখন দেন তখন কোন কোন বিষয় আপনাদের মাথায় থাকে?
উত্তর : প্রথমত সাধারণত কার্ডিওলোজিস্টরা যাঁরা স্ট্যান্ট করেন তাঁরাই অবস্থা বুঝে রোগীকে আমাদের কাছে পাঠান।urgentPhoto
অনেক সময় রোগী নিজেও স্বেচ্ছায় আসেন। অনেক সময় দেখা যায় সে স্ট্যান্ট করেছে আগে একবার ব্লক ধরা পড়েছিল। তারপরও আবার বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে। শুরু হওয়ার পরও আবার এনজিওগ্রাম করে দেখা গেল আবার ব্লক হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে আমরা বাইপাসের পরামর্শ দেই।
যেসব রক্তনালিতে ১০০ শতাংশ ব্লক থাকে অথবা ৯০ থেকে ৯২ শতাংশ ব্লক থাকে সেই ক্ষেত্রেও আমরা বাইপাসের পরামর্শ দেই।
প্রশ্ন : বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাকের পর বাইপাস সার্জারি এই বিষয়টির প্রতি এক ধরনের ভীতি কাজ করে এবং একটি ধারণা সাধারণত হয়, এই সার্জারির পর রোগী হয়তো আর বাঁচবে না। এই বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী? কেন এই ভয়?
উত্তর : আসলে এটির ক্ষেত্রে বুক কাটা থাকে তো তাই মানুষের ভিতরে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। তবে এ দেশে অনেক রোগীরই আমরা সাধারণত বাইপাস সার্জারি করি। আজ থেকে পাঁচ সাত বছর আগেও অনেক রোগী পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যেত। এখন আমাদের দেশেই এই সার্জারি খুব ভালো হচ্ছে। ভয় কাজ করে এ জন্য যে, মানুষ ভাবে বুক কেটে ফেললাম হয়তো আর কোনো কাজ করা যাবে না। এটা অজ্ঞতা থেকে হয়। আসলে এর সঙ্গে কাজের কোনো সম্পর্ক নাই। অন্যান্য অস্ত্রপচারের মতোই এটা একটা স্বাভাবিক অস্ত্রপচার। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের কাছে যেসব রোগী আসে তাদের পরামর্শ দেই, বুঝাই। অনেক রোগীই এখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে। যে কারণে তারা এখন বাইপাস সার্জারি করতে আগের থেকে বেশি আগ্রহী হয়।
প্রশ্ন : আরেকটি প্রসঙ্গে যাই বাইপাস সার্জারির সঙ্গে এনজিওগ্রামের একটি সম্পর্ক রয়েছে। কতখানি ব্লক আছে আর্টারিতে এটি বোঝার জন্য এনজিওগ্রাম একটি পদ্ধতি এটি নিয়েও একটি ভয় আছে। এনজিওগ্রাম সম্বন্ধে আমাদের একটু ধারণা দেবেন?
উত্তর : এনজিওগ্রাম হচ্ছে একটি পরীক্ষা। যেমন : আমরা রক্ত পরীক্ষা করি, আল্ট্রাসোনোগ্রাম করি। ঠিক এখানেও এনজিওগ্রাম একটি পরীক্ষা। যেটা করতে আমাদের সময় লাগে তিন থেকে পাঁচ মিনিট। পরামর্শ একটি বিষয়ে। রোগীকে বোঝাতে হবে যে এনজিওগ্রাম একটি পরীক্ষা, এটা করতে বেশির ভাগ ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচ সাত মিনিটেও হয়। এটাতে ভয়ের কোনো কারণ নেই।
প্রশ্ন : কী দেখেন এর মাধ্যমে আপনারা? দেখার পর কখন বাইপাস সার্জারি করতে হবে নির্ধারণ করেন?
উত্তর : এনজিওগ্রামের মাধ্যমে আমরা দেখি রক্তনালির কোথায় ব্লক আছে। বাইপাসের সিদ্ধান্তটা তখনই হয় যখন রক্তনালির গোড়ায় ব্লক থাকে, ৯৯ শতাংশ, ১০০ শতাংশ। সাধারণত একে আমরা লেফ্টমেন করনারি আর্টারি ডিজিজ বলি।
প্রশ্ন : এই যে শতাংশগুলো সেগুলো কিসের ভিত্তিতে করা হয়?
উত্তর : ব্লকের ওপর নির্ভর করে। বিশেষজ্ঞরা এটা বুঝতে পারেন। তখন আমরা রোগীকে এনজিওগ্রাম করার পরামর্শ দেই। যদি জরুরিভিত্তিতে লাগে তখন বলি দ্রুত বাইপাস করান। সাধারণত লেফটমেন করনারি আর্টারি ডিজিজ যেগুলোকে বলি অর্থাৎ রক্তনালির গোড়াতেই যদি সমস্যা থাকে, ব্লক থাকে সেগুলোকে আমরা খুব জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রপচার করতে বলি।
প্রশ্ন : এই অস্ত্রপচার কতক্ষণ ধরে চলতে থাকে এবং পরবর্তীকালে কী করার পরামর্শ দেন?
উত্তর : অস্ত্রপচার করতে সময় খুব লাগে না। সাধারণত তিন থেকে চার ঘণ্টার ভেতরে একটি বাইপাস সার্জারি করা সম্ভব যদি সব ঠিক থাকে। সাধারণত এর চাইতে বেশি সময় লাগে না।
প্রশ্ন : এর পর পরই রোগীদের মধ্যে একটি বিষয় থাকে কখন থেকে আবার খাবার দাবার শুরু করতে হবে? চলাফেরা করা যাবে কিংবা কখন বাড়ি ফেরা যাবে, এই বিষয়গুলো যদি একটু দর্শকদের জন্য বলেন?
উত্তর : এটি অন্য অস্ত্রপচারের থেকে একটু আলাদা। কারণ যেহেতু হৃদযন্ত্রের অস্ত্রপচার তাই অন্য বিষয় থেকে এটাতে রোগীরা কিছুটা ভয়ে থাকে। আসলে তা নয়। স্বাভাবিক একটি অস্ত্রপচার তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগে। অস্ত্রপচার যদি সকালে শুরু করি তখন ১২টা-১টার মধ্যেই রোগী পোস্ট অপারেটিভে আসে। এরপর চার পাঁচ ঘণ্টার ভেতর, বেশি হলে ছয় ঘণ্টার মধ্যে ঠিক থাকলে আমরা রোগীকে ওখান থেকে সরিয়ে দেই। পরের দিন থেকে স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া রোগী করতে পারে কোনো সমস্যা হয় না। বাইপাস সার্জারির সাত থেকে ১০ দিন পর আমরা বাড়ি পাঠিয়ে দেই। রোগীর যদি ডায়াবেটিস না থাকে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে অন্য বিষয়গুলো ঠিক থাকে, কিডনির কার্যক্ষমতা ঠিক থাকে তাহলে সাত থেকে আট দিনের ভেতর বাড়ি পাঠাতে পারি, বেশি হলে ১০ দিন লাগে।
বাড়ি ফিরে গেলে মাসখানেক অপেক্ষা করতে বলি স্বাভাবিক চলার ক্ষেত্রে, ভারি জিনিস তুলতে।
প্রশ্ন : ফলোআপ করতে রোগীকে কখন আপনারা বলেন?
উত্তর : আমরা রোগীকে সাত দিন বা ১০ দিন পর একবার আসতে বলি। তার পর হয়তো মাসিকভাবে । এরপর ছয় মাস পর, তারপর এক বছর পর আসলেই একবার চলে।
প্রশ্ন : এটির সঙ্গে বিটিং হার্ট সার্জারি বলতে একটি বিষয় আছে। এটি একটু আমাদের দর্শকদের জন্য বোঝান?
উত্তর : বিটিং হার্ট সার্জারি হচ্ছে হার্টবিট (স্পন্দন) করবে এভাবেই আপনি গ্রাফ লাগাবেন। এখানে হার্টকে আমরা থামাব না। সাধারণত দুই বারে সার্জারিটি হয়। একটি হলো বিটিং হার্ট সার্জারি আরেকটি হলো স্টপ হার্ট সার্জারি। বিটিং হার্ট সার্জারিতে আমরা অক্সিজেনারেটর ব্যবহার করি না। যদি আমরা হার্ট বন্ধ করি তখন অক্সিজেনারেটর ব্যবহার করি। অক্সিজেনারেটর একটি যন্ত্র, যার মাধ্যমে আমরা রক্ত চলাচল ঠিক করি।
প্রশ্ন : এই সার্জারিটা কখন করেন আপনারা?
উত্তর : বিটিং হার্ট সার্জারিটা বেশ কঠিন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে করতে হয়। এর মধ্যে প্রশিক্ষণ থাকতে হয় এবং এই কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।
প্রশ্ন : এটি কি বাংলাদেশে হচ্ছে?
উত্তর : আমাদের দেশে অনেকেই বিটিং হার্ট সার্জারি করে। এটি সফলভাবেই হচ্ছে। এর ফলাফলও অনেক ভালো। এই সার্জারিতে খুব তাড়াতাড়ি রোগী সুস্থ হয়ে যায়। যেসব রোগীর কিডনি কার্যক্রমে সমস্যা আছে, দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে, স্ট্রোকের ইতিহাস আছে, তাদের জন্য এটি নিরাপদ।
প্রশ্ন : সার্জারির পরে অনেক রোগীই মনে করেন ওষুধ খাওয়ার বিষয়টি হয়তো আর সেভাবে পালন করা লাগবে না। এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : বেশির ভাগ রোগীই মনে করেন বাইপাস সার্জারির পর হার্টে আর কোনো ব্লক হবে না। এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। বাইপাস সার্জারি একটি অস্ত্রপচার। এরপর এটাকে মেনে চলতে হবে। নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। চর্বিজাতীয় খাবার এড়িয়ে যেতে হবে। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনির রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। পাশাপাশি প্রতিদিন নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করতে হবে। প্রতি তিন মাস বা ছয় মাস পর লিপিড প্রোফাইল, রক্তে শর্করা, ক্রিয়েটিনিন , এইচবিএওয়ানসি এই পরীক্ষাগুলো করতে হবে। এই পরীক্ষাগুলো করে চিকিৎসককে দেখাতে হবে।
আর ওষুধ খেতে হবে চর্বি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। হৃদরোগ যেন প্রতিরোধ করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যার ব্লক হয়েছে আগে, যাকে বাইপাস করা হয়েছে তার অনেক সতর্ক থাকতে হবে যেন সেটা আবার না হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।