স্মরণ
আবার আমের দিন এসেছে, ফরীদি ভাই!

আমাদের দেশে নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে হালের জনপ্রিয় কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কার সঙ্গে অভিনয় করতে চান? প্রায় ৯৯ শতাংশ সাক্ষাৎকারের উত্তরে দেখেছি একটি নাম—হুমায়ুন ফরীদি। কথাটা বলার উদ্দেশ্য, এ মানুষটি যেমন তাঁর ভক্তদের কাছে প্রিয়, একইভাবে তাঁর সহকর্মীদের কাছে ভীষণ রকম শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার পাত্র। নাটক লেখার সূত্রে ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। ২০০৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের গল্প অবলম্বনে আমি একটা টেলিফিল্ম লিখি ‘অনাথ বাবুর ভয়’। সেখানে অনাথ বাবুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। চরিত্রটার কার্যকলাপ তিনি অনেক পছন্দ করেছিলেন, শুনেছি পরিচালকের মুখে। এর কিছুদিন পর তিনি আমার লেখা একই পরিচালকের আরেকটা ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেন। সেখানে তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের চরিত্র করেছিলেন। তাঁর একটা আফসোস ছিল, তিনি নাকি কখনো অন্ধের চরিত্র করেননি। কথাটা আমাকে বলেছিলেন নাটকের পরিচালক গোলাম সোহরাব দোদুল ভাই। সেটা শোনার পরে ওই সাইকিয়াট্রিস্ট চরিত্রটি আবার নতুন করে সাজালাম। এবার সাইকিয়াট্রিস্ট হলো অন্ধ সাইকিয়াট্রিস্ট। চরিত্রটা উনি এত পছন্দ করলেন যে শুটিং ইউনিটে উনি নাকি বারবার বলছিলেন, ছেলেটা ভালো লেখে। ওকে আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও। শুটিং হয়েছিল শ্রীমঙ্গলে। শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে উনি আবার পরিচালককে ফোন করে বললেন, কই, তুমি ছেলেটাকে আনলে না! এসব কথাই দোদুল ভাইয়ের মুখে শোনা। তার পর একদিন তিনি আমাকে তাঁর ধানমণ্ডির বাসায় নিয়ে গেলেন। সেই প্রথম আমার এই অসামান্য অভিনেতাকে খুব কাছ থেকে দেখা। বড় কোনো কিছুর সামনে দাঁড়ালে নাকি মানুষ মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। আমার হয়েছিল তাই। একজন মানুষ বড় হলে তাঁর ভেতরটাও হয়তো আকাশের সমান হয়ে যায়। তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি আগে। রাগী...মেজাজি...যা...তা; কিন্তু তাঁর সঙ্গে পরিচয় না হলে আমি জানতাম না, একজন মানুষ কতটুকু বিনয়ী হতে পারেন! একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে কতখানি সম্মান দিতে পারে! আমার মতো একজন অতি সামান্য লেখককে তিনি পাশে বসিয়ে জানতে চাইলেন, ভালো আছো ভাইয়া?
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথা নাড়ি।
তিনি বললেন, তুমি আমাকে একটা এক পর্ব দিবা, আর একটা ধারাবাহিক দিবা। ঠিক আছে?
আমি আবারো মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথা নাড়ি। সেটা ২০১০ সাল। সেই থেকে শুরু। এর পর থেকে ফরীদি ভাই যত নাটক পরিচালনা করেছেন, তার প্রায় সবকটিই আমার লেখা। আমি ধন্য, এই মহান মানুষটা কোনো বিচিত্র কারণে আমার লেখা পছন্দ করে ফেলেছিলেন। আমি সাধারণত নাটকের সেটে খুব একটা যাই না। তার প্রধান কারণ আমার ব্যস্ততা। দ্বিতীয় কারণ, আমার ধারণা, সেটে একমাত্র নাট্যকারেরই কোনো কাজ থাকে না। ফরীদি ভাই আমার লেখা প্রথম নাটকের শুটিংয়ের আগেই বললেন, তুমি কিন্তু শুটিংয়ে আসবে। আমার অন্য কাজ থাকলেও এতবড় বুকের পাটা নাই যে তাঁকে না বলব। তাঁর শুটিং দেখতে গিয়ে আমি প্রথম উপলব্ধি করি, আমাদের দেশে নাট্যকারেরও বিরাট একটা সম্মান আছে। প্রত্যেক আর্টিস্টের সঙ্গে তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। খাবার সময় তাঁর পাশের সিটে বসিয়ে খাওয়ালেন। কিছু লাগবে কি না বারবার জিজ্ঞেস করলেন। চিত্রনাট্যে কোথাও কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন হলে আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, শান্তনু, এটা এমন না করে এমন করা যায় কি না! আমার বারবারই মনে হচ্ছিল, এ কাজগুলো একজন হুমায়ুন ফরীদির না করলেই বা কি! এখন মনে হয়, এ কাজগুলো একজন হুমায়ুন ফরীদির পক্ষেই সম্ভব।
আমার একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। সেদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লিখতে বসেছি। হঠাৎ ফোন। লেখার সময় ফোন বেজে উঠলে মনে হয়, ফোনটা তুলে পানিভর্তি বালতিতে চুবিয়ে রাখি! বিরক্ত চোখে মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিন দেখে তড়াক করে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে ফোনটা ধরি।
—জি ভাই, স্লামালাইকুম...
—কোথায় তুমি?
—জি ভাইয়া, বাসায়...
—একটু আসতে পারবা, আপন ঘরে?
—জি ভাইয়া, পারব। এখন?
—হ্যাঁ, ঘণ্টাখানেক পরেও আসতে পারো।
—আচ্ছা, ঠিক আছে।
তাড়াহুড়ো করে গোসল সেরে গেলাম শুটিংবাড়িতে। তিনি ভাবলেশহীন মুখে বললেন, তোমাকে খেতে ডাকছি। যখন আমি উত্তরায় শুটিং করব, তুমি আমার সঙ্গে খাবা।
—জি ভাইয়া।
তাঁর চলে যাওয়ার পর যতবারই আপনঘর শুটিংবাড়িতে গিয়েছি, কানে বেজে উঠেছে তাঁর সেই কথাগুলো। নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছে। চোখে পোকা পড়েছে বলে অন্যদিকে তাকিয়ে সামলে নিয়েছি নিজেকে। ফরীদি ভাই, আবার একদিন আপনার সঙ্গে বসে খেতে চাই, এক টেবিলে।
শুটিংয়ের সময় অনেক বিষয় নিয়েই তাঁর সঙ্গে কথা হতো। ধর্ম, রাজনীতি, দেশ, সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথ। প্রতিটি বিষয়ে তাঁর পরিষ্কার ভাবনা, আমাকে কতটা স্বচ্ছ করেছে সে, কেবল আমি জানি। মাঝেমধ্যে উনি বলতেন, তুমি তো আমার পাগলামির দিনগুলো দেখ নাই। এ বলেই কোনো একটা পাগলামির নমুনা দিতেন, ‘একবার কক্সবাজার গিয়েছি শুটিং করতে। সারা দিন শুটিং করে রাত ৩টায় মনে হলো, ঢাকা যাব। সব ফেলে চলে এলাম ঢাকা।’
আসলেই, তাঁর পাগলামির দিনগুলোতে তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। আমি তাঁকে পেয়েছি, তাঁর জীবনের শেষ দুটি বছর যখন তিনি একই সঙ্গে ক্ষ্যাপাটে, দুর্বল, স্পষ্টভাষী, প্রশ্রয়দাতা, হতাশাবাদী ও স্বাপ্নিক। শীতকালটা শারীরিকভাবে তাঁর একটু খারাপ কাটে। তাই শীতের শুরুতেই তাঁকে সাবধান করে দিতাম নানা বিষয়ে। মানুষটা স্রেফ শিশুর মতো হেসে উড়িয়ে দিতেন। সেবার মধ্য জানুয়ারি, দুই হাজার বারো। বাইরে হাড়-কাঁপানো শীত। তিনি অসুস্থ। ভর্তি করা হলো হাসপাতালে।
প্রচণ্ড হাসপাতাল-ভীতি ছিল তাঁর। দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই একটু সুস্থ হয়ে বাসায় আসেন। রাতে ফোনে কথা বললাম। বারবার বললেন, বাসায় এসো...দোয়া করো...। দু-একদিনের মধ্যে যাব, কথা দিলাম। সেই দুদিন পরে দেখতে যাওয়া যে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত হবে, কল্পনাও করিনি কোনো দিন। আমার মোবাইলে এখনো তাঁর নম্বরটা সেভ করে রেখেছি। যতদিন ফোন ব্যবহার করব, নম্বরটি সংরক্ষিতই থাকবে। জানি, এ নম্বর থেকে আর কোনো দিন কেউ কল রিসিভ করে ভরাট গলায় বলবে না, হ্যাঁ, শান্তনু! বলো...! কত কিছুই তো বলার ছিল ফরীদি ভাই...আপনি কি জানেন, এ পৃথিবীটা যদি হয় একটা বাগান আর মানুষগুলো সেই বাগানের ফুল, তাহলে আপনি সেই বাগানের সবচেয়ে সুগন্ধি ফুল, যে ফুলের গন্ধে সব ফুল মাতোয়ারা হয়। যে ফুল ঝরে গেলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সবকিছু অর্থহীন মনে হয়।
একবার ফরীদি ভাইয়ের বাসায় গেছি। দুপুরের পর পর। তিনি বেডরুমের সোফায় বসে টিভিতে খেলা দেখছিলেন। তাঁর বাসার ছেলেটাকে ডেকে আমাকে নাশতা দিতে বললেন। কাটা আম, মিষ্টি, চা আরো কী কী যেন ছিল। আমি আমের পিরিচটা নিতেই বললেন, একটু দুধ ছিটিয়ে দিই? খুব টেস্ট।
আমি বললাম, দ্যান।
উনি সোফার পাশ থেকে গুঁড়া দুধের একটা ছোট কৌটা বের করে খানিকটা দুধ আমের ওপরে ছিটিয়ে দিলেন। আবার আমের দিন এসেছে, ফরীদি ভাই। এসেছে আপনার জন্মদিন! আহা! এই আনন্দের দিনেও কেন বারবার চোখটা শুধু পোড়ায়!