গান কথা গল্প
পঞ্চমদা আমাকে ‘ঢাকাইয়া’ ডাকতেন : এন্ড্রু কিশোর
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/04/27/photo-1430118247.jpg)
১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর। মিনু বাড়ৈয়ের কোল আলোকিত করে জন্ম নিল এক ফুটফুটে শিশু। মা তাঁর প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের নামে সদ্যোজাত সন্তানের নাম রাখলেন ‘কিশোর’। ধীরে ধীরে ছেলেটি বড় হয়ে সংগীতাঙ্গনে পা রাখল। তারপর কোনো একদিন স্বমহিমায় সেই ছেলে কিশোর কুমারের গানে ভাগ বসাল। সেই ছেলেটি আর কেউ নন, আমাদের বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। বাবা ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ। মা রাজশাহীর বুলনপুর মিশন গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা থাকায় সেখানেই পড়াশোনায় হাতেখড়ি। সংগীত পাঠ শুরু রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। আশির দশকে প্লেব্যাকের জগতে পা রাখার পর থেকে বাংলা, হিন্দিসহ বহু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তাঁর বহুসংখ্যক গান স্থান করে নিয়েছে মানুষের হৃদয়ে, স্মৃতির মণিকোঠায়। নিজের অর্জন নিয়ে একেবারেই কথা বলতে নারাজ তিনি। তার পরও বিভিন্ন জনপ্রিয় গানের গল্প ও কথা প্রথমবারের মতো তিনি বলেছেন শ্রোতাদের জন্য। কারণ, এন্ড্রু কিশোর শুধু একজন মানুষ নন, তিনি বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের সংগীতশিল্পী। একটি নির্দিষ্ট সময়ের বাংলা গানেরও প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।
হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস
এটা আমার জীবনের একটি অবিস্মরণীয় গান। এই গানের জন্য আমি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই ১৯৮২ সালে। ‘বড় ভাল লোক ছিলো’ সিনেমার গান এটি। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক সাহেবের লেখা। আলম খানের সুর। আসলে হক ভাই গান লিখতেন না তখন। এই ফিল্মের প্রোডাকশন ‘শাওন সাগর’ ওই সময়ের বড় এবং খুবই শিক্ষিত প্রোডাকশন হাউস ছিল। তাদের অধিকাংশ ফিল্মেই মোটামুটি বার্তা থাকত এবং নান্দনিক ছিল। এই ফিল্মের পরিচালক মহিউদ্দিন সাহেব একজন নামী প্রফেসর ছিলেন। সবাই তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করত। উনার বয়স অনেক হয়ে যাওয়ায় তাঁকে দিয়ে একটা সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা করা হলো। যেটা দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া যাবে, যাতে শেষ বয়সে উনি পুরস্কার পান এবং সম্মান পান। আর সত্যি সত্যি অনেক পুরস্কারও পেয়েছিল এই ছবি। সে হিসেবে হক ভাইকে গান লিখতে দেওয়া হয়েছিল।
আমার এখনো মনে আছে, আমি তখন আলম ভাইয়ের বাসায় বসে আছি, হঠাৎ এই গানটি নিয়ে উপস্থিত হলেন হক ভাই। গানটি দিয়ে বললেন, ‘আলম সাহেব গান তো লিখতে বলেছেন। কিন্তু গান তো লিখি না আমি। লিখতে চাইও না। কারণ, যাই লিখতে যাই তা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন লিখে শেষ করে ফেলেছেন! আর যদি নতুন কিছু না দিতে পারি, তাহলে তো লিখে লাভ নেই। আমি অনেক চিন্তা করে একটা ছোট্ট জিনিস লিখে এনেছি, জানি না এটা আপনার কেমন লাগবে। তবে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কেউই এই শব্দগুলো তাঁদের গানে ব্যবহার করেননি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি গানটা পুরোপুরি শেষ করতে পারি, তাহলে এই গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার দিতে বাধ্য। কারণ, এ ধরনের গানের কথা আগে হয়নি। আপনি যদি আমার চাওয়ামতো সুর করতে পারেন, তাহলে আপনিও পুরস্কার পাবেন। আর আপনি যাঁকে দিয়ে গাওয়াবেন, তাঁর ১০০ পার্সেন্ট লাগবে না, ৬০ পার্সেন্টও যদি গাইতে পারে, তাহলে সেও জাতীয় পুরস্কার পাবে নিশ্চিত।
অবাক করা বিষয় হলো, গানটি গাওয়ার পর শামসুল হক ভাইয়ের সব কথা সত্যি ফলে গিয়েছিল। পরে যখন বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হলো, তখন তাঁরা দুজনই আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁদের কথা হলো, তাঁরা দুই গীতিকার সেই সাম্রাজ্যবাদের পর থেকে আধুনিক গান নিয়ে এত গবেষণা করেছেন, তবুও এসব শব্দ তাঁরা খুঁজে পাননি এবং যাঁদেরকে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল ভাবা হয়, তাঁরাও এসব শব্দের ব্যবহার করেননি। ‘তো, এই গীতিকার ছেলেটি কে?’ প্রশ্ন করলেন। আমি হেসে বললাম, ‘ছেলেটা না, উনি একজন ভদ্রলোক। আমাদের দেশের প্রখ্যাত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।’
একচোর যায় চলে
১৯৭৮ সাল। আলম খানের সুরে ‘প্রতীক্ষা’ সিনেমার গান এটি। আমার রেকর্ড করা তৃতীয় গান। কিন্তু রিলিজ হওয়া প্রথম গান। গানটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আর যেটা আমি প্রথমে গেয়েছিলাম, সেটা রিলিজই হয়নি। এদিকে, শিবলী সাদিকের পরিচালনায় ‘তিন কন্যা’ সিনেমাটিতে যখন গান হয়, তখন কলকাতায় বাংলাদেশের তিন সংগীত পরিচালক—আলাউদ্দিন আলী, সুজেয় শ্যাম আর আলম খান কাজ করছিলেন। আমারও সেখানে গান গাওয়ার কথা, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে একটা শো করতে গিয়ে পাসপোর্ট জটিলতায় সেখানে প্রায় ২০/২৫ দিন আটকে গেলাম। পরে দেশে এসে বাসায় একটি চিঠি পেয়ে ইন্ডিয়ান ভিসা করে কলকাতায় চলে গেলাম। সেখানে গান নিয়ে আমার জন্য তিনটি পার্টি অপেক্ষা করছিল। আমার যেতে দেরি হওয়ায় কেদার ভট্টাচার্য নামের এক শিল্পী এরই মধ্যে ‘তিন কন্যা’ ছবির গান গেয়ে ফেলেছেন, যিনি পরবর্তী সময়ে ‘কুমার শানু’ নামে পরিচিতি পান। তো, সুজেয় শ্যামদার একটা-দুটা গান গাওয়ার পর তৃতীয় গানটা গাওয়ার জন্য যখনই শানু প্রস্তুত, তখন আমি গিয়ে স্টুডিওতে হাজির হলাম। তখন আমাকে দেখে একজন বললেন, ‘আমাদের শিল্পী এন্ড্রু চলে এসেছে, ওই ছেলেরে বের করে দাও।’ আমি বললাম, ‘না, এটা হতে পারে না। উনি একজন শিল্পী। আমি তো এটা করতে পারি না।’ শানু তখন বাইরে এসে আমাকে বলল, ‘তোমারই গান দাদা, প্রডিউসার চাইছে, তুমি গান গাইবে না কেন? আমি তোমার তিন-চারটা গান গেয়ে ফেলেছি দাদা। আমার আর দরকার নেই। আমার জীবনে রেডিওতে গান গাইনি, কোথাও গান গাইনি। তোমার দেরি হওয়ায় সিনেমায় প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। ব্যস, মেরে দিলাম।’ এই কথা কিন্তু কুমার শানু আজো মনে রেখেছে। পৃথিবীর যে জায়গাতেই গেছি, শানু নিজে থেকে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেছে, খোঁজখবর নিয়েছে।
আমার সারা দেহ খেও গো মাটি
১৯৮৪ সালের কথা। ‘নয়নের আলো’ ছবির গান এটি। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে প্রথম পুরো একটি সিনেমার সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাই। শুধু তাই নয়, পুরো সিনেমার গানের গীতিকার, সুরকারও তিনি। আর প্রযোজক ছিলেন ফরিদ ভাই। খুবই ভদ্রলোক। একদিন তাঁর অফিসে ডাকলেন। আমি আর বুলবুল ভাই গেলাম। গিয়ে দেখি, সিনেমার পরিচালক বেলাল আহমেদ বসা। ফরিদ ভাই বললেন, ‘এন্ড্রু তুমি তো বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ছেলে। জানো, আমি লেখাপড়া শিখে এই সিনেমার লাইনে এসে খুব ভুল করেছি। আমার ছেলেমেয়েরা বলে, সিনেমার প্রডিউসার। কী সব আজেবাজে ছবি তোমরা বানাও। বলতে তাদের নাকি লজ্জা লাগে। খুব চিন্তা করে দেখলাম। বয়স তো হয়ে গেছে, এখন এমন ছবি একটা বানাতে চাই, যে সিনেমার নাম আমার ছেলেমেয়েরা একটু গর্বের সঙ্গে বলতে পারবে—এই সিনেমার প্রযোজক আমার বাবা।’ সে উদ্দেশ্য নিয়েই ছবিটা বানানো।
সবকিছুই নতুন চান তিনি এই ছবিতে। পুরোনো কেতাদুরস্ত গল্প, পুরোনো অভিনেতা নিয়ে কাজ করবেন না বলে জানালেন তাঁরা। সে জন্য বুলবুল ভাইকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। তিনি এর আগে ‘নাগরদোলা’ ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে কিছু কাজ করেছিলেন। বুলবুল ভাই আমাকে সিলেক্ট করলেন। উনারা বললেন, ঠিক আছে। মজার বিষয় হলো, এই গানের যেদিন রেকর্ডিং ছিল, সেদিন আমার গলার অবস্থা খারাপ ছিল। তো, আমি বললাম, ‘আজকে ভয়েস খারাপ, অন্য একদিন ভয়েস দিই।’ তখন মিউজিক ট্র্যাক শুরু হয়েছে কেবল। বুলবুল ভাই বললেন, ‘না না, টাইম নাই। আজকে গাও। আজকে গানের মুডে আছি, তুমি গাও।’ আমি বললাম, ‘গানের মুডে আছেন ঠিক আছে, কিন্তু আমার তো গলার অবস্থা ঠিক নাই।’ তিনি বললেন, ‘অসুবিধা নাই, তুমি গাও।’ তার পরও গানটি গাইলাম। গাওয়ার পরও গানটি আরেক দিন করব বলে অনুরোধ করতেই বুলবুল ভাই বললেন, ‘শোনো এন্ড্রু, তুমি তো গাইছ গান, কিন্তু আমার চোখে তো পুরো ছবিটা। ছবিতে একটা ছেলের বাবা মরে যাওয়ার পর তার মনের যা অবস্থা, তার মনে যে উথালপাথাল ঢেউ, তা-ই ফুটতে হবে। তখন সেই ছেলের গান তো পুরোপুরি সুরে হবে না। সেই গান একটু ক্রেক করবে, ভুল থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। ১০০ ভাগ গাইতে পারলে তো ওই ছেলের ভেতরে দুঃখ নাই। এই যে একটু একটু ভুল আছে, এটাই আমার দরকার। এটাই ওকে। আর এটা স্ক্রিনে আমার রেজাল্টও দিবে।’ আমার গলা খারাপ ছিল বলে ওই খুঁতগুলো রয়ে গিয়েছিল, যা পরে সিনেমার প্রয়োজনে শাপে বর হয়।
আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে
এটিও ‘নয়নের আলো’ ছবির গান। প্রযোজকের কথামতো বুলবুল ভাইয়ের তখন নতুন মেয়ে শিল্পী দরকার। আমি বুলবুল ভাইকে সামিনা চৌধুরীর কথা বললাম। তখন কিন্তু বুলবুল ভাই সামিনাকে চিনত না। সামিনার তখন ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’ এবং ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’ গানগুলো রিলিজ হয়েছে। তারপর একটা গিটার নিয়ে আমি আর বুলবুল ভাই রিকশা করে সামিনাদের মোহাম্মদপুরের বাসায় গেলাম। তখন সামিনার মা, মানে ভাবি (শিল্পী মাহমুদুন্নবীর স্ত্রী হিসেবে ভাবি ডাকতাম) বললেন, ‘না, আগে আমি গান দেখব, তারপর সিদ্ধান্ত।’ এতে বুলবুল ভাই কিছুটা রাগ করে আমাকে বললেন, ‘চলো, আর গান করা লাগবে না।’ বুলবুল ভাইয়ের ইগোতে লেগেছিল। ‘আমি তাঁকে সিনেমায় গান গাওয়াতে এসেছি। আর উনি বলছেন গান দেখবেন?’ আমি বুলবুল ভাইকে বুঝিয়ে বসালাম। তারপর গানটা দেখে ভাবির পছন্দ হলো। বলে রাখা দরকার যে, সামিনা চৌধুরী কিন্তু তখনো কিশোরী মাত্র। তাই মা হিসেবে সবকিছু দেখভাল ভাবি করতেন। তারপর সামিনা এলো, গান শিখল। আমার সঙ্গে এই ডুয়েট গানটি করল। এটা কিন্তু সামিনার সঙ্গে আমার প্রথম দ্বৈত গান। যদিও পরে ওর সাথে ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’ গানটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
তুমি যেখানে আমি সেখানে, সে কি জানো না
এই গানটা যে সময়কার, সে সময় কিন্তু এ ধরনের গান কোনো ক্ষেত্রেই ছিল না। সিনেমায় তো ছিলই না। কোনো ব্যান্ডেরও এ ধরনের গান ছিল না। কারো ধারণাই ছিল না, এ রকম একটা গান হতে পারে। এটা ১৯৮৩ সালে ‘নাগ পূর্ণিমা’ সিনেমার গান। গীতিকার ছিলেন মনিরুজ্জামান মুনির। ওই ছবির নায়ক ছিলেন সোহেল রানা। তিনি তো বেশ স্মার্ট লোক। উনি আলম ভাইকে বললেন, ‘একটু ইংরেজি গানের মতো করে গান করেন।’ আলম ভাই বললেন, ‘ইংরেজি করব মানে, আপনার সিনেমা তো বাংলা? একদম ইংরেজি গান তো আর হবে না, তবে ইংরেজির আদলে একটা বাংলা গান হবে বলতে পারি।’
তার পরে অনেক গবেষণা-টবেষণা করে আলম ভাই এই চমৎকার এবং ব্যতিক্রম গানটি সুর করলেন। গানটিতে তালের কী জানি একটা ব্যাপার আছে, যা খুবই কঠিন। ২৪ মাত্রার মতো করে কন্টিনিউয়াস একটা মিউজিক বাজতে থাকে, যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। গানের ট্র্যাক তৈরি হলো, কিন্তু আমার তো ভরসা নাই এই গান আমি কীভাবে গাইব! গানটি তুললাম। তারপর আলম ভাইকে বললাম, স্কেলটা একটু নামিয়ে দেন। তখন আলম ভাই বললেন, ‘পারভেজ (সোহেল রানা) আসুক, তারপর স্কেল নামায় দিবো নে।’ পরে পারভেজ ভাই এলেন। উনি শুনে বললেন, ‘কী মিয়া, তুমি বাংলাদেশের স্টার আর তুমি বলছ পারবা না? দেখো চেষ্টা করে, তুমি পারবা।’ আমি বললাম, ‘পারছি না তো ভাই, এত ওপরের স্কেলে গাইলে তো আমি মারা যাবো।’ পারভেজ ভাই বললেন, ‘তুমি আমার গায়ক। তোমার গলায় সব গান আমাকে মানায়। তুমি মরে যাও না পড়ে যাও বুঝি না, তোমাকে ঠিক এই স্কেলেই গাইতে হবে।’ পরে ঈশ্বরের নাম নিয়ে স্টুডিওতে ঢুকলাম। রেকর্ডিং যিনি করছিলেন, তিনিও আমার কষ্ট দেখে পারভেজ ভাইকে বললেন, ‘ওর এই স্কেলে গাইতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।’ তার পরও পারভেজ ভাই না মেনে বললেন, ‘কষ্ট করেই গাও। কষ্ট করলেই কেষ্ট মিলবে। বেঁচে থাকবে এই গান।’ কী আর করা, এই হাইস্কেলের গানটি গাইতেই হলো।
আজও বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা বুড়িগঙ্গার ধারা
ভাবতে ভালো লাগে, আমিই একমাত্র বাংলাদেশি যে আরডি বর্মনের সুরে হিন্দি গান গেয়েছি। বাংলাও গেয়েছি। মোট তিনটি গান আমি গেয়েছিলাম। তার মধ্যে দুটি হিন্দিতে এবং বাংলা ছবির জন্য একটি বাংলায়। ‘ইসকি টুপি উসকি সার’ নামের গানটা হিন্দিতে গেয়েছিলেন কিশোর কুমার, যার বাংলা ভার্সনটা আমি গেয়েছিলাম। বিখ্যাত গীতিকার মাজরু সুলতানপুরির লেখা ‘সুরেজ চান্দা’, ‘মে তেরি বিসমিল হু’ এই হিন্দি গান দুটি গাওয়ার পাশাপাশি বাংলা ‘মুখে বলো তুমি হ্যাঁ, ‘এর টুপি ওর মাথায়’ এবং ‘আজো বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা’ গানগুলো পঞ্চমদার সুরে গেয়েছিলাম। তখন ১৯৮৫ সাল। যৌথ প্রযোজনার ছবি। ভারতের হয়ে প্রযোজক ও পরিচালক ছিলেন প্রমোদ চক্রবর্তী। ভারতে এই ফিল্মের নাম ছিল ‘শত্রু’ আর বাংলাদেশে ‘বিরোধ’। অভিনয়ে রাজেশ খান্না ও শাবানা। এ সিনেমায় গান গাইতে গিয়ে খুবই জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। আমি তখন দেশের বাইরে। এসে শুনলাম, ‘শাওন সাগর প্রোডাকশনের’ একজন প্রযোজক আমাকে খুঁজছেন। উনার সঙ্গে যোগাযোগ করে পরের দিন ভারতীয় দূতাবাসে গেলাম। সেখানে এক বড় কর্মকর্তাকে আমার পরিচয় দিয়ে খুব গর্ব করে তিনি বলেলেন, ‘এন্ড্রু কিশোর বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত গায়ক। আপনাদের আরডি বর্মনের সুরে গান গাইতে আপনাদের দেশে যাবে। কাল-পরশুর মধ্যে ভিসার ব্যবস্থা হলে ভালো হয়। মুম্বাইতে স্টুডিও রেকর্ডিং আছে।’ ওই কর্মকর্তা অনেকক্ষণ শুনে মুচকি হেসে বললেন, ‘যাবেন তো ঠিক আছে, কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট কই? ওটা ছাড়া তো গান গাইতে পারবেন না।’
যা হোক, তার পরও মুম্বাইতে চলে গেলাম। কাউকেই চিনি না। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর পরিচালক প্রমোদ চক্রবর্তী খুবই অল্প সময়ের মধ্যে আপন করে নিলেন। উনার আদি বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। আলাপের একপর্যায়ে ‘ওয়ার্ক পারমিটের’ বিষয়টি উঠলে উনি বললেন, ‘বলিস কী! আমি তো ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। তুই এখানেই থাক, ঘুরে ঘুরে মুম্বাই শহরটা দেখ। বিকেলে পঞ্চমের ওখানে তোকে নিয়ে যাব। আমি দিল্লিতে গিয়ে তোর ওয়ার্ক পারমিটের ব্যবস্থা করি।’ পরে সন্ধ্যাবেলা পঞ্চমদার মুম্বাইয়ের বান্দ্রার বাসায় গেলাম। পঞ্চমদা আমাকে কখনই নাম ধরে ডাকেননি। আদর করে ‘ঢাকাইয়া’ বলেই ডাকতেন। সৌজন্য আলাপের পর পঞ্চমদা বললেন, ‘শোন ঢাকাইয়া, তুই প্রতিদিন বিকেলে আমার এখানে চলে আসবি।’ এর পরেই কেয়ারটেকারকে ডেকে বললেন, ‘এই ঢাকাইয়া এলে এই সিটিং রুম খুলে বসতে দিও।’ বলে রাখি, সংগীত পরিচালকদের সিটিংরুমে সবাই প্রবেশ করতে পারে না। কারণ, সিটিংরুম খুবই সিক্রেট জায়গা। সেখানে সুর সৃষ্টি হয়। এতে সুর লিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু উনি কেন জানি প্রথম থেকেই আমাকে খুব স্নেহ করলেন এবং সিটিংরুমে বসার অনুমতি দিয়ে দিলেন। পরে আমাকে গানগুলো শেখার জন্য উনি নিজে গেয়ে একটি ক্যাসেটে করে দিলেন। আমি খুবই দুর্ভাগা। আমার কাছ থেকে শোনার নাম করে লোকে নিয়ে গেছে আর ফেরত দেয়নি সেটি। সেখানে পঞ্চমদার নিজের গলায় গাওয়া তিনটা গান ছিল। সেটার আর্কাইভ ভ্যালু এখন কী হতো, বুঝতেই পারেন। শুধু তাই নয়, তিনটা গান কতভাবে গাওয়া যায়, চারবার-পাঁচবার করে গেয়ে গেয়ে দেখানো ছিল ক্যাসেটিটিতে।
ক্যাসেটে উনি নির্দেশনা দিয়েছিলেন, ‘ঢাকাইয়া তুই এইভাবে গাইতে পারিস, তুই এভাবেও গাইতে পারিস, আচ্ছা এ রকম গেয়ে দেখ তো।’ সেই সময় পঞ্চমদার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। এত কাছের হয়ে গেলাম যে, আশা ভোঁসলের সঙ্গে কীভাবে প্রেম হলো, সেসব গল্পও করতেন আমার সঙ্গে। তার পর দেশে চলে এলাম। পরে ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার প্রায় এক-দেড় মাস পর আবার মুম্বাই গেলাম এবং স্টুডিওতে ভয়েস দেওয়া শুরু করলাম।
সুরাজ চান্দা সাগর পার্বত সাব হে পেহেলে জেসে
তো, ‘আজো বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা বুড়িগঙ্গার ধারা’ গানটির হিন্দি ভার্সন ‘সুরাজ চান্দা’ গানটি আমি গাচ্ছি, ওমা! দেখি, প্রমোদদা ও পঞ্চমদার মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। প্রমোদ চক্রবর্তী বললেন, ‘পঞ্চম গান ঠিক আছে, কিন্তু আমার কোথায় যেন ভুল মনে হচ্ছে।’ পঞ্চমদা বললেন, ‘তুমি বলো কী ঠিক হচ্ছে না? আমি মিউজিক ডিরেক্টর, কিন্তু আমি তো কোনো ফাঁক পাচ্ছি না।’ তারপর দুজনের ঝগড়ার শেষে সমাধান করতে আশা ভোঁসলেকে ডাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর আশাজির কথা শুনেই আমার হাত-পা এবং গলা কাঁপা শুরু হয়ে গেল। পঞ্চমদা তা দেখে বললেন, ‘কী রে, তোর নার্ভাস লাগছে নাকি ঢাকাইয়া?’ আমি বললাম, আশাজিকে কে ডেকেছেন? উনি বললেন, ‘আমি তো ডাকতে চাইনি। তোর চাটুজ্জে নিয়ে আসছে।’ ঘণ্টা কয়েক পরে আশাজি এলেন। তখন আশাজিকে আমার গান শুনে উচ্চারণে কোথায় ফাঁক আছে, সেটা ধরে দিতে এবং ঠিক করে দিতে বলা হলো। তখন আশাজি খালি গলায় গানের স্থায়ীটি গাইতে বললেন। এবং বললেন, ‘পঞ্চম আমাকে তোমার কথা অনেক বলেছে যে, তুমি ঢাকায় ফিল্মে অনেক গান করো। নিশ্চয়ই তুমি কিছু সাইন ব্যবহার করো? আমি গেয়ে দেখাচ্ছি, তুমি যদি তোমার সাইনগুলো ব্যবহার করো, তাহলে আমার সঙ্গে গানের ফারাকগুলো কী হচ্ছে তুমি বুঝে নিতে পারবে এবং তোমার সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।’
তারপর উনি খালি গলায় গাইলেন আর আমি সাইন ব্যবহার করে ঠিক করে নিলাম। তারপর আশাজি বললেন, ‘এবার তুমি ভয়েস দাও। আমি শুনি।’ কিন্তু আমি তো আর গাইতে পারছি না। আমি বললাম, ‘না, আপনি সামনে থাকলে আমি প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি, গান গাইতে পারছি না।’ এটা শুনে পঞ্চমদা একদম খেপে গেলেন, ‘ব্যাটা আমি আশা ভোঁসলেকে বানালাম, তুমি আমার সামনে রাতদিন গান গাইতে পারো, আর ভোঁসলের সামনে গাইতে পারছ না?’ ব্যাপারটা দাদার খুবই ইগোতে লেগেছিল। তারপর প্রমোদদা আশাজিকে অনুরোধ করাতে উনি চলে যান। পরে আমি এই গান করি। কিন্তু আমার কানের কাছে আশাজি যে চার লাইন গেয়ে শিখিয়েছিলেন, সেই চার লাইন এখনো ভুলতে পারি না। তাঁর আওয়াজটা আমার স্মৃতিতে এখনো সেরা কণ্ঠ হিসেবে বেঁচে আছে। আজীবন থাকবে।
গান শেষ। পরের দিন চলে আসব। তখন প্রমোদদা বললেন, ‘পঞ্চমের সঙ্গে দেখা করে যাস, ও খুশি হবে।’ তারপর পঞ্চমদার সঙ্গে দেখা করতে যেতে উনি আমাকে দেখেই বললেন, ‘হ্যাঁ, ঢাকাইয়া তুই আজ চলে যাচ্ছিস। ঠিক আছে ভালো থাকিস।’ আমি দাদাকে প্রণাম করে উনার সঙ্গে একটা ছবি তোলার অনুরোধ করি। শুনে দাদা বললেন, ‘হুম আমি অবাক হয়েছিলাম, মানুষ এলেই কাজ করুক আর নাই করুক, আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চায়। কিন্তু তুই এত কিছু করলি, ছবি তুললি না।’ আমি দাদাকে বললাম, ‘আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। কাজেই যা কিছু আমার হৃদয়ে থাকে, তাই করি। আমি কৃত্রিম কিছুতে বিশ্বাসী না।’ পঞ্চমদা একপর্যায়ে বললেন, ‘তুই হয়তো ভাবছিস, পঞ্চমদার সঙ্গে অনেক ভালো সম্পর্ক, কাজ করবেন তোকে ডাকবেন, কিন্তু এটা সম্ভব নয়। কারণ, আমরা ইন্ডিয়ান। আমাদের ন্যাশনাল ফিলিংস বেশি। তাই সম্ভব না তোকে বাংলাদেশ থেকে ডেকে ডেকে এখানে এনে গান গাওয়ানো। তবে হ্যাঁ, তুই যদি এখানে থাকতে চাস, এখানে তোদের সম্প্রদায়ের ভালো মেয়ে খুঁজে বের করে দেব। তুই চিন্তা করিস না। থাকতে পারিস। কিন্তু সিদ্ধান্তটা তোর।’ আমি এক সেকেন্ডের মধ্যেই উত্তর দিয়েছিলাম, ‘দাদা, আমি যেখানে আছি খুব ভালো আছি এবং মনে করি, ওই জগৎটাই আমার। এই জগৎটা আমার জন্য নয়।’
উনি আমাকে বুকে জড়ায় ধরে বললেন, ‘তুই আসলেই বাঘের বাচ্চা। এই সাবকন্টিনেন্টের কোনো শিল্পী নাই যে পঞ্চমদা তাকে একটা কথা বলবে, আর তা সে ফিরিয়ে দেবে! ইউ নো ইউর কোয়ালিটি।’ আমি বললাম, ‘যেখানে কিশোর কুমার জীবিত, সেখানে আমার পক্ষে তো সম্ভবই না কোনো কিছু করা।’ তিনি বললেন, ‘এটা যে তুই বুঝেছিস, এটা কেউই বোঝে না।’ এটাই শেষ। আর জীবনে উনার সাথে দেখাও হয়নি, কথাও হয়নি। যখন উনি মারা যান, তখন আমার বউ আমাকে বলেছিলেন, যাও, গিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দাও। কিন্তু আমি যেতে চাইনি। সেখানে কেউ নেই। কে আমাকে চিনবে তখন। একমাত্র পঞ্চমদাই তো ছিলেন। বিরাট স্মৃতি আমার, কিন্তু এগুলো কোথাও কোনোদিন বলা হয়নি, বলিনি!
আমার সার্টিফিকেট নাম এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ। কিন্তু যখন ফিল্মে এলাম, একদিন দেওয়ান নজরুল নামের একজন পরিচালক বললেন, ‘আচ্ছা এন্ড্রু, তোমার এত বড় একটা নাম। তুমি কি চিন্তা করে দেখছ, কমার্শিয়ালি এর কোনো ভ্যালু নেই! এই নামটা শুট করতেই তো ১০ রিল ফিল্ম বেশি লাগবে।’ তার পরে উনি বললেন, ‘দেখো পৃথিবীতে অধিকাংশ স্টার আর্টিস্টের নাম দুই শব্দের—এলভিস প্রিসলি, লতা মুঙ্গেশকার, উত্তম কুমার, মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার সবারই দুই শব্দের নাম। খামোখা তুমি এই চার শব্দের নাম কী করে রাখো বলো তো? লোকে তো মনে রাখতে পারবে না।’ আমি মনে করি, আমার জীবনে খুব ভাইটাল একটা কথা বলেছিলেন দেওয়ান নজরুল। আমি এখনো তাঁকে স্মরণ করি। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার পুরো নামের মধ্যে যে দুইটা শব্দ গুরুত্বপূর্ণ, এই দুইটা রেখে বাকিটা ফেলে দাও।’ আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। কারণ, কিশোর যেহেতু ছোটবেলার ডাকনাম, সেটা তো রাখতেই হবে। আবার কুমার রাখলে কিশোর কুমারের সঙ্গে মিলে যাবে। ঝামেলা হয়ে যাবে। ক্রিশ্চিয়ানিটির কারণে ‘এন্ড্রু’টা রাখতেই হবে। তাহলে পৈতৃক ‘বাড়ৈ’ টাইটেলটা ফেলে দিতে হবে। আমি রাজশাহীতে বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। বাবা খুবই দুঃখ পেলেন। বললেন, ‘বাপদাদার টাইটেলটা ফেলে দিলি?’ আমি বললাম, ‘না বাবা, ফেলে দেওয়ার ব্যাপার না। নিজের প্রফেশনের প্রয়োজনই এটা করতে হবে। সার্টিফিকেটে তো সবই থাকছে।’ এর পরেই হয়ে গেলাম ‘এন্ড্রু কিশোর’।
আমি মনে করি, সংগীতই হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কর্ম। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে মানবজাতির সম্পর্ক তৈরির সিঁড়িটা হচ্ছে সুর বা সংগীত। তাই এটা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ চাকরিটাই করছেন।