শিশুর ডায়রিয়ার লক্ষণ, চিকিৎসায় করণীয়

ছবি : এনটিভি
শিশুর ডায়রিয়া একটি প্রচলিত সমস্যা। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। ডায়রিয়া হলে করণীয় কী, এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. নাজমুন নাহার। বর্তমানে তিনি বিআরবি হাসপাতালে নবজাতক ও শিশু বিভাগে পরামর্শক হিসেবে কর্মরত। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৫৯৪তম পর্বে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : শিশুর ডায়রিয়া হওয়ার পেছনে কারণগুলো কী?
উত্তর : তার আগে আমি একটু বলতে চাই শিশুর ডায়রিয়া আমরা কখন বলব। ডায়রিয়া খুব প্রচলিত একটি সমস্যা। এটি বড়-ছোট সবারই হতে পারে। তবে ছোটদের বেলায় এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে। কারণ, শিশুদের ওজন বড়দের তুলনায় কম থাকে। তাই তারা খুব দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে। তো ডায়রিয়া কখন বলব?
শিশুরা সাধারণত এক থেকে দুই বার পাতলা পায়খানা করতে পারে। তবে এটি ডায়রিয়া নয়। যদি একটি শিশু, দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার পাতলা পায়খানা করে তখনই তাকে আমরা ডায়রিয়া বলব। সাধারণত দুই বছরের নিচের বাচ্চাদের ডায়রিয়া ভাইরাস দিয়ে হয়। ভাইরাসের মধ্যে রোটা ভাইরাস বেশি হয়। এ ছাড়া ব্যাকটেরিয়া দিয়েও হতে পারে। একটু বড় বাচ্চাদের সাধারণত ব্যাকটেরিয়া দিয়েই হয়। এ ছাড়া অন্য অনেক কারণেই ডায়রিয়া হতে পারে।
প্রশ্ন : মলের প্রকৃতি দেখে বা ধরন থেকে কি এটি বোঝা যায় কী কারণে ডায়রিয়া হচ্ছে?
উত্তর : যেমন, ভাইরাল ডায়রিয়া যদি হয়, পায়খানার রংটা সাদাটে হবে। অনেক বেশি পরিমাণে হবে। অনেক সময় অনেক মারাত্মক আকারও ধারণ করতে পারে। তবে ব্যাকটেরিয়াল ডায়রিয়াতে সাধারণত দেখা যায়, মলের রংটা হয়তো পরিবর্তন নাও হতে পারে। শুধু পাতলা হতে পারে, পানি থাকতে পারে এবং অনেক সময় এর সঙ্গে রক্ত মিশে থাকতে পারে।
প্রশ্ন : কী কারণে হয়েছে, সেটি কীভাবে বোঝা যাবে? উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয় কখন?
উত্তর : যখন পাতলা পায়খানার পর বাচ্চাটি পানিশূন্য হয়ে যাবে, তখন চিন্তিত হওয়ার বিষয়। পানিশূন্যতা হয়েছে, এটি কীভাবে বুঝব? যখন শিশুটি খুব খিটখিটে হয়ে যাবে, বিরক্ত থাকবে খুব, অথবা শিশুটি যদি একদম নেতিয়ে পড়ে, চোখ যদি গর্তের ভেতর ঢুকে যায়, চামড়া কুঁচকে যায়, টেনে ছেড়ে দিয়ে খুব ধীরে এটি যাচ্ছে, তাহলে বুঝতে হবে শিশুটির পানিশূন্যতা হচ্ছে। এ ছাড়া পাতলা পায়খানার সঙ্গে জ্বর চলে আসতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, ডায়রিয়ার সঙ্গে রক্তও আসতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, খিচুনিও চলে আসতে পারে। তো এসব উপসর্গ যখন দেখবে, তখন মা-বাবাকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে এবং অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : আর যেটি সাধারণত হয়ে থাকে, সে হয়তো মল ত্যাগ করছে দিনে ছয় থেকে সাত বারের বেশি। পানিশূন্যতা আসার আগে নিশ্চয়ই কিছু প্রতিরোধের ব্যবস্থা রয়েছে। সেটা কী হতে পারে?
উত্তর : যখনই মা দেখবে তার শিশুটি তিন থেকে চার বার পাতলা পায়খানা করছে, তখন মাকে সতর্ক হতে হবে, যাতে তার পানিশূন্যতা না হয়। কারণ, যখনই পাতলা পায়খানা হয়, তখনই শরীর থেকে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। সেজন্য সে খুব দ্রুত পানিশূন্য হয়ে যেতে পারে। তো এটি যাতে না হয়, এ জন্য দুই থেকে তিন বার পায়খানা করলেই তাকে খাবার স্যালাইন দিতে হবে। এটি ওআরএস নামে পরিচিত। ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন যেটি, এটি ডাব্লিউএইচও অনুমোদিত, যেকোনো ব্র্যান্ডের খাওয়ানো যাবে। সঠিকভাবে গুলিয়ে তাকে খাওয়াতে হবে।
প্রশ্ন : খাবার স্যালাইন বানানোর সঠিক নিয়ম কী?
উত্তর : খাবার স্যালাইনের যে প্যাকেটগুলো পাওয়া যায়, আধা লিটার ফুটন্ত ঠাণ্ডা পানির মধ্যে গুলিয়ে নিতে হবে। কখনো অল্প একটু স্যালাইন অল্প একটু পানি, কখনো পানি বেশি, পানি কম, স্যালাইন বেশি বা কম এভাবে গুলানো যাবে না। একদম আধা লিটার পানিতে এক প্যাকেট, স্যালাইন গুলাতে হবে। পানিটি হতে হবে বিশুদ্ধ। ফুটানো ঠাণ্ডা পানিতে এক প্যাকেটের সম্পূর্ণটি দিয়ে ভালোভাবে মেশাতে হবে। এরপর একে ঢাকনা দিয়ে রাখতে হবে। এটা আট থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত রাখা যায়। একটু আগেভাগে এটি খাইয়ে দিতে হবে। ছয় থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে খাওয়ানো ভালো। এরপর যদি শেষ না হয় ফেলে দিতে হবে। আবার নতুন করে বানাতে হবে।
প্রশ্ন : অনেক সময় ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : এটি করা যাবে না। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখতে হবে। গরমের দিন হলে আট ঘণ্টা রাখা ভালো, ঠাণ্ডার দিন হলে ১২ ঘণ্টা রাখা যেতে পারে।
প্রশ্ন : নবজাতকের ক্ষেত্রে ডায়রিয়ার সমস্যা হলে, অনেকে মনে করেন, মায়ের বুকের দুধ থেকে সমস্যা হচ্ছে। তখন বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : নবজাতকের ক্ষেত্রে ছয় মাস পর্যন্ত শুধু যখন বুকের দুধ খায়, তখন কিন্তু আট থেকে ১০ বার সে পায়খানা করতে পারে। সেটা পাতলাও হতে পারে। তবে এটি স্বাভাবিক। দুধে ল্যাকটোজ নামে একটি পদার্থ থাকে, যার জন্য পায়খানাটা নরম হতে পারে। এই ক্ষেত্রে মায়ের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই, যদি আট থেকে ১০ বার সে পায়খানা করে। ডায়রিয়া তখনই বলব, যদি সে টানা পায়খানা করতে থাকে, পানির পরিমাণ বেড়ে যায়।
ডায়রিয়া হলেও বুকের দুধ বন্ধ করা যাবে না। বরং তখন বেশি বেশি করে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। আর খুব বেশি করলে বুকের দুধের সঙ্গে তাদেরও খাবার স্যালাইন দেওয়া যাবে। একই নিয়মে গুলিয়ে তাদের খাবার স্যালাইন দিতে হবে।
প্রশ্ন : শিশুদের খাবার স্যালাইনের প্রতি একটি অনিহা থাকে। এ ক্ষেত্রে পানশূন্যতা কীভাবে পূরণ করবে?
উত্তর : খাবার স্যালাইন যেটি ওআরএস, এ ছাড়া কিছু স্যালাইন বাজারে পাওয়া যায়। সেগুলো হলো, টেস্টি স্যালাইন বা রাইস ওআরএস। সে যদি সাধারণ স্যালাইন খেতে না চায়, সেক্ষেত্রে এগুলোও দেওয়া যাবে। তবে শুধু পানি খুব বেশি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাহলে ডায়রিয়ার জন্য শরীর থেকে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। শুধু পানি দিলে পানিশূন্যতা পূরণ হবে, তবে লবণের ঘাটতি পূরণ হবে না। শুধু পানি বেশি খাওয়ানো হলে ডায়রিয়া বেড়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন : একটু বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আমরা অনেক সময় দেখি মা-বাবা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কিছু ওষুধ দিয়ে থাকেন। এগুলো দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে কি?
উত্তর : এটা আসলে দেওয়া উচিত না। ডায়রিয়া বন্ধ করার কোনো ওষুধ দেওয়া আসলেই উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে শিশুর পেট ফুলে যেতে পারে। ডায়রিয়া হবে, তবে পানিশূন্যতা যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বলা হয় যে বমিও যদি করে দেয়, তাকে আবার খাবার স্যালাইনটাই খেতে বলার জন্য।
আর যদি এমন হয়, খুব বেশি বমি হচ্ছে, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে আইভি ফ্লুইড দিতে হবে।