মহৎ পেশার মানুষ
কাজই আনন্দ, কাজই জীবন : ডা. এম আর খান
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/06/15/photo-1434347862.jpg)
এক নামেই তিনি পরিচিত। ডাক্তার এম আর খান। তিনি দেশের জাতীয় অধ্যাপক, বাংলাদেশের শিশু চিকিৎসার জনক হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট সাতক্ষীরার অজপাড়াগাঁ রসুলপুর থেকে অভিযাত্রা শুরু হয় এই বিখ্যাত মানুষটির। তিনি নিজেই এক ইতিহাস, একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি এ দেশের শিশুস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথিকৃৎ। সুচিকিৎসক, সুহৃদ ও সদালাপী এই মানুষটি সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন তাঁর চড়াই-উতরাই ও স্বপ্নের গল্প।
ফিরে যাই ছেলেবেলায়
ছেলেবেলা আমার কাছে বেশ আনন্দের ছিল। আমার মা ভালো লেখাপড়া জানতেন। তাঁর কাছেই হাতেখড়ি আমার। নিজের সন্তানদের পাশাপাশি পাড়ার শিশুদেরও শিক্ষালাভের জন্য তিনি সাহায্য করতেন। আমার বাবা ১৯১৪ সালের দিকে এনট্রান্স পাস করেছিলেন। সে সময়ে বাংলাদেশের কোনো মফস্বল শহরে এনট্রান্স পাস করা ছিল বেশ বড় ব্যাপার।
ছেলেবেলায় আমি সারা দিন খেলতাম, সাঁতার কাটতাম। সারা দিন খেলা শেষে সন্ধ্যার পর পড়তে বসে ঘুমে ঢলে পড়তাম। পড়া আর হতো না। মূলত সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত পড়তাম। ফুটবল খেলতাম, থিয়েটার দেখতাম, এগুলো বেশ আনন্দের সঙ্গে করতাম। আমরা চার ভাই। মেজ ছিলাম আমি। আমার বাবা ভালো ফুটবল খেলতেন। ভাইরাও ফুটবল খেলত। রসুলপুর স্কুল দলের অধিনায়ক হিসেবে ১৩টি ট্রফি পেয়েছিলাম। ক্রিকেট টিম করেছিলাম সিক্স ফিল ব্রিগেড টিম নামে।
রসুলপুর প্রাইমারি স্কুল থেকে পাস করে সাতক্ষীরা সদরের প্রাণনাথ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে (পিএন স্কুল) ভর্তি হই। ১৯৪৩ সালে এই স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করি। ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতায় গিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হই। ১৯৪৫ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করি। এর পর ১৯৪৬ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। ১৯৫২ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করি।
চিকিৎসা পেশায় কেন
আমাদের দেশে তখন চিকিৎসক কম ছিল। বাবা চিন্তা করতেন, ছেলে ডাক্তার হবে। আমরা চার ভাই। প্রত্যেকেই স্ব-স্ব অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। খুব কর্মঠ ছিলাম ছোটবেলা থেকেই। সব কাজ সময়মতো করতাম। কোনো কাজ ফেলে রাখতাম না। মূলত মা-বাবার ইচ্ছাতেই এই পেশায় আসা। ডাক্তারি পাস করে শিশুস্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগ দিই। শিশু চিকিৎসার মান বাড়াতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। শিশুদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এ পেশায় আসা আমার। শিশুরা যদি ঠিকমতো বেড়ে না ওঠে, ভালো স্বাস্থ্য নিয়ে সে জীবনে কিছুই করতে পারে না।
চিকিৎসা পেশা মহৎ পেশা। সবাই ভক্তি করে, দোয়া করে, আবার পয়সাও দেয়। এ রকম পেশা কয়টা আছে! আবার উল্টোটাও হয়। গোলমালে পড়লে পিট্টিও খেতে হয়।
শিক্ষক ছিলেন অনুপ্রেরণা
মা-বাবা তো অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেনই, পাশাপাশি শিক্ষক গিরেন্দ্রনাথ ছিলেন আমার জীবনের অনুপ্রেরণা। তিনি সাহিত্যিকও ছিলেন এবং শিক্ষকও ছিলেন। আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। তিনি এমন একজন শিক্ষক ছিলেন, যিনি সব বিষয়ে পড়াতে পারতেন। তিনি প্রাণনাথ হাই ইংলিশ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। প্রাণনাথ ছিলেন জমিদার। এটা ছিল ব্রিটিশ বাংলাদেশের দ্বিতীয় হাই স্কুল।
একজন চিকিৎসকের লড়াই
১৯৫২ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর সাতক্ষীরায় ফিরে আসি। উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৫৬ সালে বিদেশে যাই। বিদেশে পড়াশোনা শেষে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার কেন্ট সহকারী রেজিস্ট্রার এবং এডিনবার্গ গ্রুপ হাসপাতালে রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করি। দেশে ফিরে এসে ১৯৬৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অব মেডিসিন পদে যোগ দিই। এর পর ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (শিশুস্বাস্থ্য) পদে যোগ দিই।
আমাদের দেশে তখন শিশুদের ডাক্তার দু-একজন ছিলেন। শিশু চিকিৎসকের সংখ্যা এখন এক হাজার একশর ওপরে হয়েছে। তখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে শিশুদের জন্য কোনো বিভাগ ছিল না। বেড ছিল না। তখন মরহুম প্রফেসর এ কে খান ফিমেল ওয়ার্ড থেকে আমাকে চারটি বেড দিলেন শিশুদের ওয়ার্ড চালু করার জন্য। একজন চিকিৎসক দিলেন সহযোগী হিসেবে। এই নিয়ে শুরু হলো রাজশাহী মেডিকেল কলেজের চিলড্রেন ইউনিট। রাজশাহীতে এক সভায় একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক আমাকে পরিচয় করানোর সময় ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ইনি হলেন আমাদের শিশু চিকিৎসক। শিশু চিকিৎসক আর পশু চিকিৎসক তো এক, পশুও কথা বলতে পারে না, শিশুও না।
তখন আমি বুদ্ধি করে উত্তরে বললাম, আপনি যা বলেছেন, সেটা ঠিকই আছে। তবে আপনি যদি আপনার সন্তানকে পশু ভাবেন, তাহলে আমার কিছু করার নেই।
নাদিয়া বেগম ছিলেন রাজশাহীর সেই সময়ের বড় গায়িকা। তাঁর ভাই একবার ভীষণ অসুস্থ হলেন। আমি তাঁর চিকিৎসা করি। ভাগ্যক্রমে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। তখন তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, অ্যালোপ্যাথিক ওষুধেও রোগ ভালো হয়। এর আগে অধিকাংশ মানুষ হোমিওপ্যাথির ওপর নির্ভর করত। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার ওপর মানুষের বিশ্বাস আনাতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তারা ভাবত, অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কড়া। শিশুদের না দেওয়াই ভালো। তারা বলত, হোমিওপ্যাথি খাওয়াও। ভালো হলে হলো। খারাপ তো আর হবে না। পরে বুঝল, অ্যালোপ্যাথি একটি বিজ্ঞান। এ অবস্থা কাটতে চার-পাঁচ বছর লেগেছে।
সে সময় সবাই ব্যঙ্গ করে বলত, এই লোক কখনো অধ্যাপক হতে পারবে না। কোনো পোস্ট নাই। তখন আমার স্ত্রী আনু মন খারাপ করত। আমি বলতাম, বিশ্বাস হারিও না। দেখো প্রফেসর না, এর থেকেও বেশি কিছু হবো। এখন আমাকে সবাই ডাকে। মেডিকেল পেশার বাইরের লোকেও ডাকে।
১৯৬৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে যোগ দিই। এখানে এসে কাজের পরিধি অনেক বেড়ে গেল। এক বছরের মধ্যেই ১৯৭০ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাই। ১৯৭১ সালে ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমআর), বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলের অধ্যাপক হই। ১৯৭৩ সালে এই ইনস্টিটিউটের যুগ্ম পরিচালকের দায়িত্ব পাই। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়ন, ছেলে পড়ানো, শিক্ষা কারিকুলাম, চিকিৎসকদের সঙ্গে বসা সব করতাম। সে সময় প্রফেসর নুরুল ইসলাম ডিরেক্টর ছিলেন। আমার একমাত্র মেয়ে ম্যান্ডি মজা করে বলত, বাবা, অ্যাক্টিংয়ের কাজ কেমন চলছে। বলতাম, অ্যাক্টর তো অভিনয় করে, লোকে ভালো বলতে পারবে কী হচ্ছে।
১৯৭৮ সালের নভেম্বরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে অধ্যাপক ও পরিচালকের পদে যোগ দিই। একই বছরে আইপিজিএমআরের শিশু বিভাগের অধ্যাপকও নিযুক্ত হই। কাজে আমি কোনো সময় ফাঁকি দিইনি। সব সময় ধরে নিয়েছি—কাজই আনন্দ, কাজই সাফল্য, কাজই জীবন।
আনন্দ পাই রোগী সুস্থ হলে
আমি তো আমাকে মূল্যায়ন করতে পারব না। মানুষই বলতে পারবে, আমি কেমন চিকিৎসক। মনে মনে ভাবি, আমার শত্রুর সংখ্যা কম, বন্ধু বেশি। তাই বলব, হয়তো কিছুটা সফল হয়েছি। শতভাগ ভালো, সেটা তো বলা যাবে না। ব্যর্থতা নেই, বলব না। আমি কাজ গুছিয়ে নিয়েই করি। খাবারের সময়, রোগী দেখার সময় সবকিছুর জন্য নির্দিষ্ট সময় আছে আমার। দুই দিন বিশ্রাম নিই—মঙ্গল ও শুক্রবার, তখন সামাজিক কাজ করি।
মানুষ তো শতভাগ সফল নয়। যে রোগী আমার কাছে ভর্তি হয়, সে যদি ভালো হয়ে যায়, ভালো লাগে। আর যদি কাউকে সুস্থ না করতে পারি, কষ্ট হয়। এসব জিনিস পয়সা দিয়ে শোধ হয় না। মানুষের দোয়া অনেক বড় জিনিস। মাঝেমধ্যে বলি, হে প্রভু, আমাকে জ্ঞান দাও। যেন ভালোভাবে মানুষের সেবা করতে পারি।
জীবনে কি অসম্পূর্ণ, কি পূর্ণ এসব চিন্তা করি না। বয়স অনেক হয়েছে। তবুও আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, এর জন্য প্রার্থনা করি। প্রার্থনা করি, আল্লাহ আমাকে যোগ্যতা দাও যেন ভালো কাজ করতে পারি।
প্রবীণদের নিয়ে কাজ করছি
বর্তমানে শিশুদের নিয়ে কাজের পাশাপাশি প্রবীণদের নিয়ে কাজ করছি। প্রবীণদের নিয়ে সরকার যে প্রতিষ্ঠান করেছে, তার সদস্য হিসেবে যুক্ত আছি। প্রবীণদের উপকারের জন্য অনেক প্রস্তাব করেছি। ৮৯ লাখ টাকা দিয়েছে সরকার। প্রবীণদের সাহায্য করার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া নিজের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালগুলো দেখছি। নিবেদিতা হাসপাতাল, সেন্ট্রাল হাসপাতাল, মিরপুর শিশু হাসপাতাল, উত্তরা মহিলা মেডিকেল কলেজ—এগুলো প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হিসেবে কাজ করেছি। এ ছাড়া কয়েক ডজন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছি।
শিশুরোগ বিদ্যার অগ্রগতি
আমরা যখন শুধু করেছিলাম, তখন তো চিকিৎসক কম ছিল। এখন অনেক হয়েছে। অনেক শাখা হয়েছে। নিউরোলজি, হেমাটোলজি এসব শাখার বিস্তার হয়েছে। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা চিকিৎসা দেন। এসব বিষয়ে পোস্টগ্র্যাজুয়েটের ব্যবস্থা হয়েছে। শিশুদের চিকিৎসার বর্তমানে প্রচুর অগ্রগতি হয়েছে। এখন শিশুরা অনেক মেধাবী। তাদের যে পরিবেশে রাখা হয়, যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা হয় তা খুব ভালো। আগে অনেক বাচ্চা হতো, এখন পরিবার পরিকল্পনা হয়েছে। বাচ্চার বিষয়ে এখন সবাই যত্নশীল হয়েছে। রাষ্ট্র এখন শিশুদের বিষয়ে অনেক সজাগ।
চিকিৎসা মহৎ পেশা
চিকিৎসাসেবা ব্যবসা নয়। রোগীরা পয়সা না দিলেও তো সে দোয়া করে। এটাও একটা বড় বিষয়। রিকশাওয়ালা থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ছেলে পর্যন্ত আমার রোগী। এই মহৎ পেশায় যাঁরা আসেন, সৃষ্টিকর্তা তাঁদের এই পেশায় আসার সুযোগ দিয়েছেন বলেই আসতে পারেন। এই পেশার মান বজায় রাখা অনেক জরুরি। সব সময় মানুষের বন্ধু হিসেবে কাজ করতে হবে। আমরা চিকিৎসকরা যদি ভাবি, রোগীটি আমার আত্মীয়, তবেই অনেক কিছুর সমাধান হয়ে যাবে।
দেশের কল্যাণে কাজ করতে চাই
মানুষের তিন জীবনে তিন রকম চিন্তা। শিশুর চিন্তা বড় হওয়া। যুবকদের কাজ করে সফল হওয়া। বৃদ্ধদের চিন্তা যা পেয়েছি, তার পর্যালোচনা করা। আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন শিশুদের এবং দেশের কল্যাণে কাজ করে যেতে চাই।