শিশুদের ওপর পারিবারিক সহিংসতার প্রভাব কতটুকু?

পারিবারিক সহিংসতা শিশুদের মানসিক বিকাশে বাধা তৈরি করে, বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শিশুদের মানসিক বিকাশে পারিবারিক সহিংসতার প্রভাবের বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৯৪২তম পর্বে কথা বলেছেন মোহাম্মদ সেলিম চৌধুরী। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল ও কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে পিএইচডি গবেষণারত রয়েছেন।
প্রশ্ন : পারিবারিক সহিংসতা একটি শিশুকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে। কী বলবেন বিষয়টি নিয়ে?
উত্তর : এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের শিশুদের মানসিক বিকাশে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো পারিবারিক সম্পর্ক। পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মা-বাবার সম্পর্ক। এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি শিশু নেতিবাচক বিষয় ঘটতে দেখে, তার ভেতরেও নেতিবাচক একটি প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে পারিবারিক সহিংসতা। পারিবারিক সহিংসতাকে আমরা এভাবে বর্ণনা করতে পারি, মা-বাবার মধ্যে কলহ, মানসিক দ্বন্দ্ব, একে অপরকে দোষারোপের বিষয় এবং সর্বোচ্চ পর্যায় হলো শারীরিক নির্যাতন।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন স্ত্রী স্বামী দিয়ে নির্যাতিত হচ্ছে, শারীরিক, মানসিক ও আবেগীয়ভাবে। এটা খুবই ভয়াবহ বলে আমি মনে করি।
শিশুর সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক থাকে গভীর। শিশু যখন দেখে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষটি নির্যাতিত হচ্ছে, তার ভেতরে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়। আক্রোশ তৈরি হতে পারে, বিষণ্ণতা তৈরি হতে পারে, জেদ তৈরি হয়। সবগুলোই নেতিবাচক। এটি শিশুর জন্য ট্রমা। অনেক সময় এই পারিবারিক সহিংসতার বিষয়টি শিশুর ওপরও পড়ে। মা-বাবা যখন নিজের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, কলহে লিপ্ত হয়, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের মধ্যেও চলে যায় তখন কী হয়? শিশু যেহেতু দুর্বল থাকে, হয় বাবা, না হলে মা, শিশুর ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্যাতন করে। নির্যাতনের মধ্যে পড়ে যায় শিশুটি। হয় অবহেলা, হয় আবেগীয় নির্যাতন, হয় শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে শিশুটি পড়ে যায়। এটা এমনিতেই হয়। মা-বাবা যে বিষয়টি ইচ্ছাকৃতভাবে করে সেটি নয়। হয়তো শিশুটির সেবা-যত্ন যেভাবে নেওয়ার কথা, সেটি কমে যায়। এগুলো শিশুর দীর্ঘমেয়াদি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।
গবেষণাগুলোতে দেখা যায়, পারিবারিক সহিংসতার কারণে শিশুদের মধ্যে মূলত দুই ধরনের মানসিক অসুবিধা দেখা দেয়।
এক ধরনের অসুবিধা ভেতরে ভেতরে ঘটে। এটা সব সময় বোঝার উপায় নেই। সাধারণ মানুষ এটা বুঝবে না। আরেক হলো বাইরে ঘটে। শিশুটি হয়তো অতিরিক্ত চঞ্চল হয়ে যাচ্ছে, হয়তো পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। এরপর হতে পারে যে স্কুলের ফলাফল খারাপ করছে। একটু যখন বড় হয়, তখন দেখা যায় মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো মা-বাবার সঙ্গে তর্ক করে। এমনকি অন্যকে আঘাত করা বা অন্যকে হত্যা করার মতো পরিস্থিতি তার ভেতর তৈরি হয়।
আর অভ্যন্তরীণ বিষয় হলো শিশু যখন বুঝতে পারে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলো মানসিক কষ্টে রয়েছে, সে প্রতিরোধ করতে পারছে না, তার মধ্যে কিন্তু একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কারণ, সে এমনিতেই দুর্বল। আর যে তাকে নির্যাতন করছে, পরিবারের নির্যাতনের জন্য দায়ী সে শক্তিশালী। আবার যাকে করা হচ্ছে সে তার সবচেয়ে কাছের। এতে সে না পারে প্রতিরোধ করতে, না পারে একে গ্রহণ করতে। এতে তার মধ্যে বিষণ্ণতা, পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, আত্মহত্যা করার মতো আচরণগুলো চলে আসে।