নবজাতকের জন্মগত ত্রুটি এবং এর সার্জিক্যাল সমাধান
একটি শিশু জন্মের সময় বিভিন্ন ত্রুটি নিয়ে জন্ম নিতে পারে। এর মধ্যে অনেক ত্রুটির সার্জিক্যাল সমাধান রয়েছে। এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩০৬৩তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. মো. আব্দুস সাত্তার। বর্তমানে তিনি পাবনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : নবজাতকের ক্ষেত্রে কী কী সার্জিক্যাল সমস্যা হয়?
উত্তর : একটি ছোট শিশু, যে পৃথিবীতে প্রথম আসে, সে মা-বাবার জন্য একটি আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। কিন্তু এই ছেলে অথবা মেয়ে যেটাই হোক না কেন তার জন্মগত ত্রুটি যখন ধরা পড়ে, মা-বাবার জন্য সেটা যন্ত্রণাদায়ক। পুরো পরিবারের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে যায়। তারা হতাশায় ভোগে কী হবে না হবে।
এই ক্ষেত্রে আমি বলব, একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করবে, সিজারিয়ান সেকশন বা স্বাভাবিক প্রসব যেভাবেই হোক না কেন প্রথমেই একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ চেকআপ করতে হবে। এটি করলে তার জন্মগত যদি কোনো ত্রুটি থাকে, তাহলে এর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যাবে। তাহলে তার ব্যবস্থাপনা অনেকটাই সহজ হবে। সে ক্ষেত্রে সেই পরিবার বিভিন্ন খরচ ও মানসিক চাপ থেকে বেঁচে যাবে।
তবে যে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই, সেখানে যে অ্যাটেনডিং চিকিৎসক থাকবেন, সে গ্রেজুয়েট হোক বা পোস্ট গ্রেজুয়েট হোক, অথবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ধাত্রী, তারা শিশুটিকে পর্যবেক্ষণ করবেন। আমি বলব, এই শিশুটির মাথা থেকে যদি আমরা দেখতে বলি বা যদি দেখি তাহলে মাথাটা বড় কি না, স্বাভাবিকের চেয়ে তা দেখতে হবে। যদি তার কাছে মনে হয় স্বাভাবিকের চেয়ে বড় তাহলে অবশ্যই একজন শিশু সার্জানের কাছে দেখাতে হবে। সে ক্ষেত্রে মাথা বড় হলে মস্তিষ্কের মধ্যে পানি জমে, পানি নিচে নামার জন্য যে নলটা থাকে সেটি চিকন থাকে। এর কারণে আস্তে আস্তে ফুলে যায়। এই রোগকে আমরা বলি হাইড্রোকেফালাস।
এটি নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জিন ভূতের আছর হয়েছে, এমন ভাবার কিছু নেই। এই ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের একটি আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে, অথবা একজন শিশু সার্জনকে দেখালে অথবা পেডিয়াট্রিক নিউরোসার্জন যারা রয়েছেন, তাদের দেখালে ভিপি সান্ট অস্ত্রোপচার বলি আমরা, মাথা থেকে পেট পর্যন্ত একটা নল সেট করে দিই। এই নলটা সেট করে দিলে এই শিশুটা পূর্ণ বয়স্ক প্রাপ্ত হবে, তখন সে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে।
দ্বিতীয় হলো, মাথার খুলিটা নাও থাকতে পারে। একে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলি এনেনসেফালি। এই ক্ষেত্রে দ্রুত একে কোনো মেডিকেল কলেজে অবশ্যই পাঠাতে হবে।
এরপর যদি নিচে নামি সে ক্ষেত্রে দেখব, গলায় একটু ফোলা থাকে কারো কারো। গলার দুই ধারে ফোলা থাকে, একে আমরা বলি সিস্টিক হাইড্রোমা। এটি নিয়েও আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। এটি হলে একজন শিশু সার্জনের পরামর্শ নিলে, তিনি সেটা সাধারণত এক বছর বা আরো পরে শিশুটির ওজন বাড়লে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়লে এটি সার্জারি করে, নিরাময় করবেন। সার্জারি করার সময় হলো ছয় মাসের পর থেকে।
এর পর গলায় ও মুখের আশেপাশে রক্তনালীর টিউমার হতে পারে। মায়েরা বলে থাকেন মশায় কামড় দিয়েছে। আসলে এটি মূলত রক্তনালীর টিউমার। এটি শরীরের যেকোনো জায়গায় হতে পারে। তবে সাধারণত মুখ ও ঘাড়ে বেশি হতে পারে।
প্রথমে এটি ছোট থাকে। পরে আকারে আস্তে আস্তে বড় হয়। বড় হতে হতে যখন আরো বড় হয়, তখন অভিভাবকদের নজরে আসে, তখন তারা ভয় পেয়ে যায়। মূলত ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এটি খুব বিনাইন রোগ। এটি ক্ষতিকর নয়। এক বছর বয়স পর্যন্ত বাড়তে থাকে। এর পর আস্তে আস্তে ছোট হতে থাকে। এর মূলত তিনটি ভাগ রয়েছে। যেটা কেবল হেমানজিওমা সেটি ঠিক হয়ে যায়। তবে যদি আর্টারিও ভেনাস বা মিক্স প্রেজেন্টেশন হয়, সে ক্ষেত্রে শিশু সার্জন বা পেডিয়াট্রিক সার্জনরা চিকিৎসা নিলে ঠিক হয়।
প্রশ্ন : এ ক্ষেত্রে সার্জারির কোনো প্রয়োজন রয়েছে কি?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে একটি ওষুধ দিলে আস্তে আস্তে কমে যায়। এতে না কমলে আমরা স্টেরয়েড ইনজেকশন দিতে পারি। এতেও যদি ভালো ফলাফল না পাওয়া যায়, তাহলে সার্জারিতে যেতে হয়।
এরপর নবজাতক শিশুর নাক মুখ দিয়ে যদি প্রচুর ফেনা আসে, তাহলে যারা চিকিৎসক রয়েছে, তারা এই শিশুকে ভালো করে সাকশন দেওয়ার পর যদি নেজলেস্টিক টিউব বা এনজোটিউব দিয়ে দেখে তাহলে ভালো। এটা সাধারণত আট থেকে ১০ সেন্টিমিটারের বেশি যাবে না। যদি না প্রবেশ করে তাহলে বুঝতে হবে বাচ্চার খাদ্যনালিটার ওপরের সঙ্গে নিচের যোগাযোগ নেই। এই অসুখকে আমরা বলছি ইসোফেজাল অ্যাট্রেসিয়া। এই ক্ষেত্রে শিশুকে মুখে খাবার দেওয়া যাবে না। খাবার দিলে চোখ মুখ কালো হয়ে আসবে। একে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলছি সায়ানোসিস। খাদ্যনালির সঙ্গে অনেক সময় ফিস্টুলা থাকে, সেক্ষেত্রে খাবার যদি ফুসফুসে চলে যায়, সেক্ষেত্রে শিশুটার প্রাণ বিনাশ হতে পারে। এরপর দ্রুত সার্জনকে পেডিয়াট্রিক সার্জনের কাছে রেফার করতে হবে। সার্জারি করার মাধ্যমে এটি ১০০ ভাগ ঠিক করা যাবে।
প্রশ্ন : এই সার্জারিটা আপনারা কখন করেন।
উত্তর : এটা যেহেতু খুব জটিল অবস্থা, তাই জন্মের পর এই সার্জারিটা করি।
এরপর আমাদের বুক ও পেটের মাঝখানে যে ডায়াফ্রার্ম বা মধ্যচ্ছেদ এর মাঝখানে ফুটো থাকতে পারে। এ রকম থাকলে নাড়িভুড়ি পেট থেকে বুকে চলে যায়। বুকের ডান বা বাম পাশে যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে জন্মের পর পরই শিশুর শ্বাসকষ্ট দেখা দেবে।
ছোট শিশুর পেট যেমন ফুলে থাকে, এখানে পেট দাবানো থাকে না। সে ক্ষেত্রে বুঝতে হবে তার একটি সমস্যা রয়েছে। আর শ্বাসকষ্ট হবে। তাহলে একদিকে শ্বাসকষ্ট, একদিকে শিশুর পেট দাবানো, এই অবস্থায় শিশুকে মুখে খাবার দেওয়া হলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। সাইনোসিস হয়ে যায়। একে আমরা বলি, কালো হয়ে যাওয়া।
সব জন্মগত ত্রুটির সমাধান রয়েছে, যদি সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে চলে যায়।