কফের সঙ্গে রক্ত যায় কেন?
সাধারণ থেকে গুরুতর, বিভিন্ন কারণে কফের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। আজ ১২ সেপ্টেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৪৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় বক্ষ্যব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেসপেরিটোরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল কাইয়ুম।
প্রশ্ন : কফের সঙ্গে রক্ত গেলে আমরা আতঙ্কবোধ করি। কী কী কারণে কফের সঙ্গে রক্ত যাওয়ার সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : আসলে কফের সঙ্গে রক্ত যাওয়াটা একটা ভীতিকর ব্যাপার। কাশির সঙ্গে রক্ত দেখলে রোগীরা ভয় পেয়ে যায়। এবং সাধারণত রোগী দ্রুত একজন চিকিৎসকের কাছে যায়। কফের সঙ্গে রক্ত আসার সাধারণ কারণ থেকে শুরু করে অনেক জটিল কারণও আছে।urgentPhoto
অনেক সময় দেখা যায় দাঁত বা মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে, যখন ব্যক্তি ঘুমিয়ে থাকে তখন সারারাত এটা মুখে জমে থাকে, এরপর সকালে ঘুম ভেঙে উঠে বেসিনে প্রথম কফ ফেলার পর উনি আতঙ্কিত হয়ে যান। আসলে এই রক্ত পড়াটি হয়েছে তার মাড়ি বা দাঁতের সমস্যার কারণে।
আবার অনেক সময় দেখা যায় রক্ত ভেতর থেকে আসছে। অর্থাৎ শ্বাসনালি বা ফুসফুস থেকে আসতে পারে। আবার ফুসফুসের বাইরেও অনেক কারণ রয়েছে। যেমন হার্টের কারণে হয়। ল্যাপ ভেন্টিকুলার ফেইলিউর সেখানে হতে পারে। মাইট্রাল এসটেনোসিসের কারণেও হতে পারে। বা রক্তের রোগ যদি হয় সে কারণেও হতে পারে। যেমন : লিউকোমিয়া, হিমোফিলায়া- এগুলোতেও কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে পারে।
প্রশ্ন : ফুসফুসের কী কারণে এই সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : শ্বাসনালি থেকে রক্ত আসতে পারে। আরেকটি হচ্ছে ফুসফুস থেকে আসতে পারে, যাকে আমরা লাঙ্গ পেরেনকাইমা বলি।
শ্বাসনালি থেকে রক্ত আসতে পারে। যেমন : একিউট বঙ্কাইটিস হলে রক্ত আসতে পারে। টিউবার কলোসিস বা যক্ষ্মা হলেও রক্ত আসতে পারে।
ফুসফুসে ক্যানসার হলে রক্ত আসতে পারে। এরপর ফুসফুসের যে রক্তনালি সেটা যদি কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায়, এর কারণেও কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে পারে। আবার দেখা যায়, ফরেন বডি অর্থাৎ বাইরের কোনো বস্তু যদি শ্বাসনালিতে চলে যায় সেখান থেকে রক্ত আসতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ছত্রাক, অর্থাৎ ফাঙ্গাল ইনফেকশন, যাকে আমরা বলি, এসপার জিলোমা- এর কারণেও সমস্যা হতে পারে। সেখান থেকে কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে পারে।
প্রশ্ন : আপনি যে বিষয়গুলো বললেন এর মধ্যে মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয় যক্ষা এবং ক্যানসার নিয়ে। কোন কারণে রক্ত আসছে এটা কী বোঝার কোনো উপায় রয়েছে?
উত্তর : এটা বলতে গেলে একটু ভেতরে যেতে হবে। অনেক সময় রোগী বলে যে আমার কাশির সঙ্গে রক্ত বা কফের সঙ্গে রক্ত আসে। আমরা অনুসন্ধান করে জানার চেষ্টা করি আসলে কি তার কফে রক্ত আসে, না কি খাদ্যনালি থেকে রক্ত আসে। যদি খাদ্যনালি থেকে আসে তবে এক রকম হবে। এ সময় একদম তাজা রক্ত হবে না একটু কালচে ধরনের রক্ত হবে।
আবার অনেক সময় দেখা যায়, নাকের কোনো সমস্যার কারণে, যেমন, সাইনোসাইটিস, পলিপ, রাইনাইটিস- এসব কারণেও রক্ত আসে। অনেক সময় রোগী নাক থেকে কাশি দিয়ে টেনে সেই রক্তটা ফেলে। তখন নাকের ভেতরের রক্তটা কাশির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বাইরে আসে। আসলে এটা ফুসফুসের নয় বা খাদ্যনালি থেকেও আসেনি, এই রক্তটা আসছে নাকের সমস্যার জন্য।
যদি রক্ত যক্ষ্মার জন্য আসে, কফের সাথে মিশেও আসতে পারে, বা আবার শুধু রক্তই আসতে পারে। একদম পরিমাণে অনেক বেশি হয়।
আর ফুসফুসের ক্যানসারের কারণে যদি রক্ত আসে তাহলে কফের সাথে মিশ্রত হয়ে আসে এবং পরিমাণে বেশি থাকে না। তবে যক্ষ্মার কারণে রক্ত এলে অনেক বেশি আসে।
আবার ফুসফুসে যদি ফোঁড়া হয় সেই কারণে অনেক বেশি রক্ত আসে। সেই সঙ্গে কফ পেকে যায়, গন্ধ হয় –তখন আমরা বুঝতে পারি ফুসফুসের ফোড়া হয়েছে।
আবার দেখা যায়, যক্ষ্মা সেরে যাওয়ার পড়ে হয়ে গেছে ব্রঙ্কক্যাকটাসিস। এটা হলে শ্বাসনালিটার ফুলে যায় সেখান থেকেও রক্ত আসে। অনেক রক্ত আসে। একেবারে ভয়ঙ্কর অবস্থা সৃষ্টি হয়। রোগীর জীবন আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে যায়।
প্রশ্ন : আপনার কীভাবে নিশ্চিত হোন সমস্যাটি কোন কারণে হচ্ছে?
উত্তর : এটা নিশ্চিত হতে আমরা কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করি। এ ধরনের রোগী আমাদের কাছে আসার কারণ খোঁজার আগে আমরা চিকিৎসা শুরু করে দেই। যদি দেখি কাশির সাথে রক্ত বেশি বেড়িয়ে গেছে তখন আমরা আগে চিন্তা করি এই রক্ত পূরণ করতে হবে। অর্থাৎ রক্ত দিতে হবে। তখন আমরা ব্লাডগ্রুপ করি। এটা করে প্রতিবেদন পেতে অনেক সময় লেগে যায়। তার আগেই আমরা একটা স্যালাইন শুরু করি। অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দেই। রক্তবন্ধ করার জন্য যে ওষুধগুলো প্রচলিত আছে সেগুলো প্রয়োগ করি। যাতে আর রক্তপাত না হয় এবং রোগীর সঙ্গে যদি এক্সরে থাকে যদি বাম বা ডান ফুসফুসে সমস্যা থাকে। যেদিকে সমস্যা আমরা তাকে সেই কাত করে শুইয়ে রাখি। এরপর রোগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরীক্ষা করি।
প্রশ্ন : বিশেষভাবে জানতে চাইব আমাদের দেশে এক সময় যক্ষ্মা ব্যাপক হারে ছিল। এখন সেটি অনেকটা কমেছে। একজন মানুষ কেন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়?
উত্তর : যক্ষ্মার একটি নির্দিষ্ট জীবাণু রয়েছে। যেটাকে আমরা বলি মাইক্রোব্যাকট্যাম টিউবার কোলোসিস। এই জীবাণু শ্বাসনালি দিয়ে ফুসফুসে চলে যায়, এরপর সেখান থেকে সংক্রমণ তৈরি করে। শেষ পর্যন্ত এটা একটা যক্ষ্মার রূপ ধারণ করে। যেটাকে আমরা বলি পালমোনারি টিউবার কোলোসিস।
প্রশ্ন : একজন মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলে তার রক্ত পড়া ছাড়াও আরো কিছু লক্ষণ দেখা যাবে- সেগুলো কী?
উত্তর : রক্ত পড়া একটা লক্ষণ। তবে যে ব্যক্তির যক্ষ্মা হয়েছে তার কাশি থাকবে। সে কাশি থেকে কফ বেড়োতেও পারে। নাও বেড়োতে পারে। আর একটি হচ্ছে তার জ্বর থাকবে। খাওয়ার রুচি কমে যাবে। স্বাস্থ্য আস্তে আস্তে খারাপ হবে। ওজন কমে যাবে এবং কাশিতে রক্ত আসতেও পারে, নাও আসতে পারে।
প্রশ্ন : যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার হার কী বাংলাদেশে কমেছে?
উত্তর : আমাদের দেশে জাতীয়ভাবে যক্ষ্মার কিছু সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান কাজ করছে। অনেক এনজিও যক্ষ্মার জন্য কাজ করছে। আমাদের একটা লক্ষ ছিল ৮৫ শতাংশ কেস ধরা এবং ৭৫ শতাংশ নিরাময় করা এই লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়েছে এবং যক্ষ্মা আগে থেকে অনেক কমে গেছে। আধুনিক চিকিৎসা হওয়ার কারণে রোগীরা ভালোও হচ্ছে।
প্রশ্ন : যক্ষ্মার চিকিৎসা দীর্ঘ মেয়াদি হয়। দীর্ঘ মেয়াদি হলে রোগীরা একপর্যায়ে চিকিৎসকের কাছে আসে না- এ রকম একটা আশঙ্কা থাকে। আপনার কী পরামর্শ এ বিষয়ে?
উত্তর : বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতেই ডিওটি অর্থাৎ ডাইরেক্টলি অবজার্ব ট্রিটমেন্ট ( সরাসরি পর্যবেক্ষণ চিকিৎসা) এই প্রক্রিয়াটি চালু রয়েছে। রোগী ডিওটি প্রদানকারী ব্যক্তির সামনে বসে ওষুধ খাবে, কেন্দ্রে গিয়ে খাবে। এতে ওষুধ ছেড়ে দেওয়ার যে প্রবণতা সেটা রোধ করা যাবে। ডিওটি পদ্ধতি চালু হওয়ার পর দেখা গেছে আগে যেমন রোগী ওষুধ ছেড়ে দিত সেটা কমেছে। দীর্ঘ মেয়াদি ওষুধ খাওয়ার চিকিৎসায় দুই তিন মাস পর দেখা যায় রোগীটি ভালো হয়ে গেল, তখন রোগী হয়তো ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিল। তবে এখন ডিওটি পদ্ধতি চালু হওয়ার জন্য রোগীরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে পর্যবেক্ষকের সামনে ওষুধ খাচ্ছে। সুতরাং এখানে ভুল হওয়ার কিছু নেই। এর ফলে চিকিৎসার সফলতা অনেক বেড়েছে।