শীতে নাক-কান-গলায় যেসব সমস্যা হয়
শীতে বাতাসের আর্দ্রতা কমে যায়। এ সময় বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দেয়। শীতে নাক-কান-গলার সমস্যা বাড়ে।
শীতে নাক-কান-গলার বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩২৫৮তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. ফুয়াদ মোহাম্মদ শহীদ হোসেন। বর্তমানে তিনি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজে ও হাসপাতালের ইএনটি বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : নাক-কান-গলার কী কী সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসে?
উত্তর : প্রথমে আগের অবস্থাটা একটু বলা দরকার। কেন নাক-কান-গলার অসুখ একটি ভিন্ন মাত্রা পায়, বিশেষ করে শীতকালে? আমাদের দেশে শীতটা আসলে এখন খুব স্বল্পস্থায়ী। এরপরও ঋতুর যে পরিবর্তন, এটি কিন্তু প্রকৃতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর নাক-কান-গলার অসুখ কেন বাড়ে? এর কারণ হলো, নাক কিন্তু শরীরের এয়ারকন্ডিশনার। আমাদের শরীরে বাতাস ঢোকার একমাত্র রাস্তা হলো নাক। নাককে আমরা হয়তো সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে চিন্তা করে থাকি। তবে এই নাকের কাজ কিন্তু অনেক। যেই বাতাসটা আমাদের ফুসফুসে যায়, একে পরিশোধন করে। ধুলা, ধোয়া এসব পরিশোধন করে ছাঁকনির কাজ করে। বাতাসে হয়তো তাপমাত্রা বেশি থাকে, একে হয়তো সে শীতল করে শরীরের উপযুক্ত করে ঠিক করে। অথবা শরীরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাপমাত্রায় নিয়ে যায়। এবং একই সঙ্গে এই বাতাসের আর্দ্রতাটা কেমন হবে, কোন আর্দ্রতায় গেলে পরে ফুসফুস সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাবে, সেটিও কিন্তু এই নাক করে।
আরেকটি জিনিস হলো নেজাল সাইকেল বলে একটি কথা রয়েছে, নাকের যে দুই নাসারন্ধ্র, এরা কিন্তু পালাক্রমে কাজ করে। এখন কী হয়? একটি কথা বলা হয়ে থাকে, আমাদের প্রত্যেকেরই নাকের হাড় কিছু না কিছু বাঁকা। কারোই নাকের হাড় এক সমান হয় না। এটি নিয়েই আমরা চলি, জীবনযাপন করি। কিন্তু যখন ঋতু পরিবর্তন হয়, তখন দেখা যায়, এই যে এয়ারকন্ডিশনিংয়ের বিষয়টি, এটিতেও একটি পরিবর্তন আসে। এর মধ্যে একটি জিনিস যুক্ত হয়, সেটি হলো অ্যালার্জিক অবস্থা। শীতে বাতাসের আর্দ্রতা অনেক কমে যায়। ধুলা-বালি, ফুলের রেণু বাতাসে অনেক বেশি থাকে। এই সময় নাকটা বন্ধ হয়ে যায়। আবার যাদের নাকের হাড় বাঁকা রয়েছে, তাদের দেখা যায় এয়ারকন্ডিশনিংয়ের জায়গায় বাড়তি একটি কাজ করতে হয়। এতে রোগীরা হঠাৎ করে বলে আমার নাকটা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে আসছে। নাকটা যখন বন্ধ হয়ে আসে, নাকের সঙ্গে সম্পর্কিত জায়গা, গলা, কান এগুলোতে সমস্যা হয়। এই সময় অনেকে বলে, আমি একটু ঠান্ডা খেলাম। এত দিন আমার কিছু হলো না, এখন তো গলাটা একটু ব্যথা করছে। টনসিলের প্রদাহটা কিন্তু এই সময় আমাদের বেড়ে যায়। কারো কারো হয়তো অঝরে নাক দিয়ে পানি পড়ছে। কেউ কেউ বলছে, সকালে আমি অনেকগুলো হাঁচি দিয়েছে।
প্রশ্ন : এটি কেন হয়?
উত্তর : অ্যালার্জিক অবস্থার কারণে। আমাদের যে নাসারন্ধ্রটা শুরু হয়েছে, যে লাইনিং ইপিথিলিয়াম দিয়ে, ফুসফুসকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সুরক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিকে আরো বেশি শক্তিশালী করে, যেন ফুসফুস সুরক্ষিত হয়। এখন এখানে একটি কথা খুব মজা করে বলা যায় যে, কারো বাসার দারোয়ান যদি সৎ হয়, তার বাসার বেডরুম অনেক সুরক্ষিত থাকবে। এখন এই প্রতিরোধটা কিন্তু শুরু হয়, দারোয়ান থেকে। অনেক সময় যারা অ্যালার্জিক অবস্থার রোগী, অ্যালার্জিক রাইনাইটিসের, তারা অনেক সময় বলে ওষুধ খেয়ে লাভ কী? আমি ওষুধ খাচ্ছি, আমি তো বেশি দিন ভালো থাকি না। তবে এখানে একটি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওষুধ খাওয়ার লাভ এটাই ওষুধ খেয়ে যখন আমরা অ্যালার্জিক অবস্থাকে কমাব, এই অ্যালার্জিক অবস্থা থেকে ফুসফুসকে আক্রান্ত করার যে বিষয়টি, এটি অনেকটাই রোহিত হবে। তা না হলে এই ধরনের রোগীরা যদি চিকিৎসাহীন অবস্থায় থাকে, তাদের একটি বিশেষ ধরনের অ্যাজমা তৈরি হয়। তারা সব সময়ই কাশে। যারা বক্ষ বিশেষজ্ঞ, তারা কিন্তু এখন অনেক সময় নাকের বিষয়টি খেয়াল করেন। অনেক সময় নেজাল স্প্রে ব্যবহার করেন। তারাও কিন্তু আমাদের কাছে রেফার করেন। তারাও চান ওই রোগীকে যদি নাকে সুরক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে ফুসফুসের সংক্রমণ অনেকটা কমিয়ে ফেলা যাবে।
আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই রোগীরা বলে যে আমি ওষুধ কত দিন খাব? যখন আপনার ঋতুতে একটি ক্রান্তিকাল চলে, গরম থেকে ঠান্ডা, ঠান্ডা থেকে গরম এবং বৃষ্টির সময়—এই ক্রান্তিকালে কেউ যদি ওষুধ খায় এবং নিয়ম মেনে চলে, তাহলে কিন্তু সে মোটামুটি সারা বছরই ভালো থাকতে পারবে।
প্রশ্ন : আরো কিছু রোগ কী রয়েছে?
উত্তর : বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তো টনসিলে সমস্যা থাকেই। বাচ্চাদের তো আপনি রোধ করতে পারবেন না। ঋতু পরিবর্তন তো তার মাথায় অতটা কাজ করে না। আরেকটি বিষয় হয়, সন্ধ্যার সময় আমরা যে ফ্যান বা এসি চালু করি, ভোররাতে কিন্তু কক্ষ তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। তখন নাকের এয়ারকন্ডিশনের কাজটা অনেক করতে হয়। সমন্বয় রক্ষা করতে গিয়ে সে হাপিয়ে ওঠে। এদের কিন্তু খুব সহজে সংক্রমণ হয়। একিউট টনসিলাইটিস নিয়ে হয়তো আসছে। আরেকটি হয়, অ্যাডিনয়েড। অ্যাডিনয়েড যে কেবল শীতে হয়, তা নয়। যেসব শিশুর টনসিলে প্রদাহ, তাদের অ্যাডিনয়েড হতে পারে। আমরা এতে তিনটি ভাগে ভাগ করি। দেখা যায়, যেসব বাচ্চার অ্যাডিনয়েড খুব বেশি বড়, এদের কিন্তু এই আবহাওয়ার পরিবর্তনটা আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ করে। তখন দেখা যায় এই শীত তাদের নিশ্চিত কাবু করে। শ্বাসের কষ্ট হয়, মুখ হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। তার ঠান্ডা লাগছে। এ ধরনের বাচ্চাদের নিয়ে মায়েরা প্রথমে শিশু বিশেষজ্ঞদের কাছে যায়। তো পরে যখন তাদের কাছে যায়, তারা বলে এগুলো তো আসলে নাক-কান-গলার রোগ। বাচ্চাদের অ্যাডিনয়েডের বিষয়ে আমরা যখন মা-বাবার সঙ্গে কথা বলি, তারা কিন্তু প্রথমে বোঝেন না। আমি অনেক শিক্ষিত মা-বাবার ক্ষেত্রে দেখেছি। আপনি অবাক হবেন, হয়তো একটি সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। আমরা যখন জিজ্ঞেস করি মা-বাবাকে, আপনার সন্তান যে হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে, এটি কি স্বাভাবিক। তখন হয়তো সে প্রথমবার খেয়াল করে বাচ্চাটা হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে।
অ্যাডিনয়েডের একটি জীবনচক্র রয়েছে। তিন থেকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত অ্যাডিনয়েডের বৃদ্ধি হয়। এরপর এটি আস্তে আস্তে নামতে থাকে। ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে ঠিক হয়ে যায়। সমস্যা হলো এই সময়ের মধ্যে যা ক্ষতি করার, সেটি কিন্তু করে ফেলে। মস্তিষ্কের বিকাশ ঠিকমতো হয় না। এদের বারবার ঠান্ডা লাগার কারণে, যত বার ঠান্ডা লাগে, তাদের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়। তা না হলে তার বিষয়টি আরো বাড়বে। তখন দেখা যায়, এসব রোগীরা দুর্বল হয়ে যায়। এদের শারীরিক বিকাশও কিন্তু কম হয়। কান আক্রান্ত হয়। এদের কানের পর্দার পেছনে পানি জমে। একটি শ্রুতি বধিরতা তৈরি হয়। দেখা যায়, এদের স্কুলের কার্যক্রম খারাপ হয়ে যায়। অনেক শব্দ দিয়ে টেলিভিশন শোনে। কারণ, শব্দতো সে শুনতে পায় না। এ ধরনের শিশুদের যদি আমরা বলি যে আপনার বাচ্চাটার অস্ত্রোপচার করে নেওয়া ঠিক হবে, তখন সবার আগে তারা বলেন যে আমার বাচ্চাটাতো অনেক ছোট। তখন তারা খোঁজেন, কোন চিকিৎসক বলবেন যে অস্ত্রোপচার লাগবে না। কিন্তু এটা এখন ফাঁকির মধ্যে পড়ে। অনেক সময় তারা হয়তো চিকিৎসকের কাছেই আর যান না। তখন তারা হয়তো এমন চিকিৎসা নেয় যে শেষ পর্যন্ত তারা প্রতারিত হয়।
আর যেটি বলতে পারি, একিউট সাইনোসাইটিস তো খুব ব্যথাযুক্ত একটি অবস্থা, এই ক্ষেত্রে তো আমাদের যে বায়ুকুঠুরিগুলো, এতে শ্লেষ্মা জমে, প্রদাহ হয়, মাথাব্যথা থাকে। অনেকে একে মাইগ্রেনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে। আবার যাদের মাইগ্রেন রয়েছে, ওষুধের মাধ্যমে হয়তো মাইগ্রেন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এটি বেড়ে যায়। মাইগ্রেন আর সাইনোসাইটিস, একই সঙ্গে দুটো হওয়াতে তারা বুঝতে পারে না, যেকোনো কারণে তার ব্যথা হচ্ছে।