ওজন নিয়ন্ত্রণে কী করবেন
বর্তমানে মুটিয়ে যাওয়া বা ওবেসিটি একটি বড় ধরনের সমস্যা। একে নিয়ন্ত্রণের জন্য ওজন ব্যবস্থাপনা জরুরি। আজ ১৩ অক্টোবর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৭৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ স্কিন অ্যান্ড লেজার সেন্টারের পরামর্শক ডা. তাওহিদা রহমান।
প্রশ্ন : স্বাস্থ্যকর ওজনের প্রয়োজনীয়তা কী? এটা মেনে চলা কেন প্রয়োজন?
উত্তর : আসলে স্বাস্থ্যকর ওজন যদি আমরা মেনে চলি, আমাদের শুধু সুন্দরই লাগবে না, এতে রোগমুক্ত থাকব। বাচ্চাদের থেকে শুরু করে সব বয়সের লোকদেরই ওজনাধিক্য একটি সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : ওজন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে স্বাস্থ্যকর ওজনের সম্পর্ক কী?
উত্তর : স্বাস্থ্যকর ওজন মানে হলো ওজনকে আপনি নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। সাথে সুস্থতাও নির্ভর করছে। কখন বুঝব আমরা বেশি ওজনের হয়ে যাচ্ছি? সেটা বডি মাস ইনডেক্স থেকে নির্ণয় করব। বডি মাস ইনডেক্স নির্ভর করবে আপনার উচ্চতা এবং ওজনের ওপর। আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কেবল ওজনের ওপর নয়, ওদের সমবয়সী অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনা করে এটা আমরা করে থাকি। বডি মাস ইনডেক্স ১৮ থেকে ২৫ যদি হলে এটা স্বাভাবিক। ১৮-এর নিচে হয়ে গেলে কম ওজন হয়ে যাবে। আর ২৫ থেকে ৩০ হলে আমরা বলি বেশি ওজন। আর ৩০-এর বেশি হলে ওবেসিটি বা স্থূল। তাই আমাদের একে ১৮.৫ থেকে ২৫-এর ভেতরে রাখতে হবে।
প্রশ্ন : ওবেসিটি বা মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যাটি এখন কেন এত বাড়ছে?
উত্তর : আসলে এটা নির্ভর করছে কতটুকু খাবার খাচ্ছি, ক্যালোরি নিচ্ছি, আর পোড়াচ্ছি এর ওপর। এখন এমন হতে পারে, আপনি অনেক বেশি খাবার খাচ্ছেন আর পোড়াচ্ছেন কম। এ জন্য স্থূল হয়ে যাচ্ছেন। আবার অন্যদিকে, আপনি হয়তো ক্যালরি ঠিকমতো নিচ্ছেন, তবে কোনো একটি শারীরিক সমস্যার কারণে সেটি পুড়ছে না। এসব কারণেই মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যাটি হচ্ছে।
ওজন বেশি হওয়ার প্রথম কারণ হিসেবে আমরা বলি, জেনেটিক অথবা হেডিটারি। মানে বাব-মায়ের মধ্যে যদি কেউ মোটা থাকে ২০ শতাংশ আশঙ্কা থাকে বাচ্চাদের মোটা হওয়ার। কারণ তাদের ফ্যাট সেল বা চর্বি কোষ জন্ম থেকেই অনেক বেশি থাকে।
এরপরে আসে খাদ্যাভ্যাস। এটা অনেক বড় একটা কারণ। এখন খাদ্যাভ্যাসে অনেক কিছু আসছে। আমরা হয়তো অল্প পরিমাণ খাবার খাচ্ছি, তবে হয়তো এতে অনেক ক্যালোরি থাকছে। যেমন : ফাস্ট ফুড বা জাংক ফুড। এগুলো বাচ্চারা বেশি খাচ্ছে। এ ছাড়া বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদেরও এসব খাওয়ার প্রতি প্রবণতা অনেক বেশি।
এরপর আসছে হয়তো আমরা কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার বেশি খাচ্ছি। কার্বোহাইড্রেট দুই রকম রয়েছে। একটা জটিল বা কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট। আরেকটি সহজ কার্বোহাইড্রেট। কমপ্লেক্স কার্বহাইড্রেট হলো সাদা জাতীয়। যেগুলো বেশি স্বাদের। যেমন চিনি, সাদা ভাত, সাদা রুটি ইত্যাদি।
এরপরের কারণ হিসেবে আসছে আপনি খাবারকে কীভাবে গ্রহণ করছেন সেটার ওপর। অনেকে ভাবছেন আমি শুকিয়ে যাব, খাবারটাকে একটু বাদ দিই। সকালের নাশতা হয়তো করছে না, একেবারেই দুপুরের খাবার খাচ্ছে। এই বিরতিতে ইনসুলিন তৈরি হচ্ছে, রেজিটেন্স হচ্ছে, মুটিয়ে যাচ্ছে বেশি। ফলে আমরা হয়তো চেষ্টা করছি কমাতে, তবে সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে যাচ্ছে।
এরপর আসছে পেশির পুরুত্ব। মেয়েদের মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি ছেলেদের তুলনায়। এর কারণ পেশির পুরুত্ব কম। পেশি যদি বেশি থাকে মেটাবলিজম বেশি হয়ে, পুড়বে বেশি।
প্রশ্ন : মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে ব্যবস্থাপনা করার জন্য কোন কোন বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে?
উত্তর : আমি আগে বলছি, যারা জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করে ওজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাদের কথা। আর আমাদের এই অনুষ্ঠানকে দেশবিদেশের অনেক বন্ধুরা দেখছে। এটি বললে সবার জন্য উপকার হবে। তাই প্রথমে জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তনের কথা বলছি। কার্বোহাইড্রেট-জাতীয় খাবার যত কম খাওয়া যায়, তত ভালো। ফল এবং সবজিজাতীয় খাবার খেতে হবে। গাঢ় রঙের সবজি যেমন গাজর, টমেটো, পালং শাক এগুলো খেতে হবে। এগুলো আমাদের দেশে সহজেই পাওয়া যায়। জাম্বুরা খেতে পারেন। যেটা চর্বি ঝরানোর খাদ্য হিসেবেই পরিচিত। লেবু খেতে হবে।
এর সঙ্গে স্ন্যাকস হিসেবে শুকনো খাবার খুব ভালো কাজ করে। যেমন : বিভিন্ন ধরনের বাদাম। আখরোট এগুলো খাওয়া যেতে পারে।
আর সতেজ থাকার পানীয় হিসেবে খাওয়া যেতে পারে ডাবের পানি। এটা সতেজও করবে এবং ওজনও নিয়ন্ত্রণে রাখবে। আর বেভারেজ হিসেবে দুধের ঘন চা এড়িয়ে গিয়ে গ্রিন টি খেতে পারেন।
প্রশ্ন : একটি খাদ্যতালিকার চার্ট বা ডায়েট চার্ট মেনে চলা জরুরি কি?
উত্তর : আপনি যদি প্রতিদিন খাবারে ৫০০ ক্যালোরি কমিয়ে দেন তাহলে সপ্তাহে সহজেই এক পাউন্ড থেকে ১০ পাউন্ড কমিয়ে ফেলতে পারবেন।
প্রশ্ন : অনেকে মনে করেন পুরোপুরি খাবার বাদ দিলে শুকিয়ে যাব দ্রুত, এটি কি সঠিক?
উত্তর : এই ধারণাটি পুরোপুরি ভুল।
প্রশ্ন : ওজন যাদের বেশি থাকে তাদের এর ব্যবস্থাপনার জন্য কীভাবে আপনারা পরামর্শ দেন?
উত্তর : অনেকে আসে তার বিএমআই বা ওজনটা নিয়ন্ত্রণে আছে, সেটাকে হয়তো ধরে রাখতে চাইছে। আবার কেউ কেউ আসে যাদের বিএমআই ৪০-এর বেশি, ওটাকে কমিয়ে আনতে চাচ্ছে। আবার অনেকে ওজন বেশি ছিল, কমিয়েছে, সেটাকে ধরে রাখতে চাইছে। এদের ওপর নির্ভর করে কে কতখানি কমাতে চাচ্ছে বা কার জন্য কোনো ব্যবস্থাপনাটা জরুরি।
প্রথমে আমি খাদ্যাভ্যাসে ফোকাস করব। এরপর ব্যায়াম, যোগব্যায়াম, মেডিটেশন এগুলো করতে হয়।
প্রশ্ন : ব্যায়াম ছেড়ে দিলে আবার কী নতুন করে ওজন বাড়ার আশঙ্কা থাকে? সেই ক্ষেত্রে আসলে করণীয় কী যে এই ওজনটা ধরে রাখা যায়?
উত্তর : নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হবে। আপনাকে পরিমিত খেতে হবে। ক্যালোরিতে ফোকাস হতে হবে। কার্বোহাইড্রেট কম খেয়ে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনযাপনের তালিকায় ২০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস রাখেন এটিই যথেষ্ট। এটা আপনাকে কেবল সুস্থই রাখবে না, দেখতেও ভালো রাখবে। আর মন প্রফুল্ল থাকবে।
দেখবেন যে, গ্রামে যারা থাকে, খোলা আলো বাতাসে ঘুরছে এদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যাটি নেই। আমরা যারা চার দেয়ালে বন্দি তাদের মধ্যে বেশি। বাচ্চাদের মধ্যে বেশি। কারণ ওরা তো খেলার জায়গা পাচ্ছে না। এরা যদি দড়ি লাফ খেলে, সাঁতার কাটে, সাইকেল চালায় ভালো কাজে দেয়।
প্রশ্ন : মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যাটি খুব বেশি হলে আপনাদের কোনো সার্জিক্যাল চিকিৎসা রয়েছে কি?
উত্তর : আমাদের তিন রকম পদ্ধতি আছে চিকিৎসার। প্রথমে আমরা ওষুধ দিয়ে শুরু করি। এখানে লাইপেস ইনহিবিটর অলহিস্টার দিতে পারি। কিছু প্রাকৃতিক শৈবাল আছে। আর হোয়াইট কিডনি বিন এক্সট্রাক্ট দিয়ে তৈরি কিছু সাপলিমেন্ট রয়েছে। যেগুলো চর্বি ঝরাতে সাহায্য করে। কার্বোহাইড্রেট আটকে দেয়। এগুলো দিই।
সার্জারিও আছে। ইনহেসিভ সার্জারি। এটা হচ্ছে লাইপোসার্জারি। আর এখন খুব জনপ্রিয় হলো ননইনভেসিভ। আলট্রাসাউন্ড ক্রায়ো-লাইপো-লাইসিস। এর সফলতার হার খুব ভালো, তবে একটু সময় লাগে।