বাংলাদেশে কিডনি রোগের চিকিৎসার অবস্থা কী?

আজ বিশ্ব কিডনি দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো, ‘সুস্থ কিডনি সকলের জন্য ও সর্বোত্র’।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটির ওপরে কিডনি রোগী রয়েছে।কিডনি রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আর এই জন্য শেষ পর্যন্ত কিডনি রোগের চিকিৎসা করা অনেকের জন্যই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে কিডনি রোগের চিকিৎসার অবস্থা, কিডনি রোগের কারণ, কিডনি সুস্থ রাখতে করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৩৭৬তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ ও অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ।
অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি বর্তমানে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটে প্রধান পরামর্শক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ কিডনি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। তিনি বর্তমানে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে কর্মরত।
এনটিভি : এই দিবসের এবার মূল প্রতিপাদ্য কী? এই দিবসকে ঘিরে এবার কী আয়োজন হয়েছে?
অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ : সারা বিশ্বেই আজ কিডনি দিবস উদযাপিত হচ্ছে। এবারের কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘কিডনি হেলথ ফর অল, এভরি হোয়ার, এভরি বডি’। আমরা এর বাংলা করেছি, ‘সুস্থ কিডনি সকলের জন্য এবং সর্বোত্র’। এই প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে আমরা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে কী করব চিন্তা-ভাবনা করছি। আমাদের সঙ্গে কিডনি ফাউন্ডেশন রয়েছে, বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। সচেতনতা অনুষ্ঠান করার জন্য ক্যাম্পস নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। পিডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনও রয়েছে কিডনি ডিজিজের ওপর, তারা সঙ্গে থাকবে।
এনটিভি : কিডনি রোগ প্রতিরোধে এই যে বিভিন্ন দিবস বা বিভিন্ন সংগঠনের কাজ, এর গুরুত্ব কতখানি?
অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ : বিশ্বে ১২৬টি দেশে আজ এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশ্বে দেখা যাচ্ছে, ৮৫ কোটি লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। সারা বিশ্বে ২৪ লাখ লোক ক্রনিক (দীর্ঘ মেয়াদে) কিডনি ডিজিজে মারা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর যে কারণ এর মধ্যে ছয় নম্বর হলো ক্রনিক কিডনি ডিজিজ। এই প্রেক্ষাপটে সচেতনতা খুব জরুরি। আমাদের কিডনি সম্পর্কে জানতে হবে। কিডনি রোগ হলে আমাদের কী করা উচিত? এবং কিডনির রোগ যদি ক্রনিক কিডনি রোগে পরিণত হয়, তাহলে কী করা উচিত?
আমাদের যদি দুটো কিডনি ৮০ থেকে ৯০ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়, তখন কিন্তু কিডনি প্রতিস্থাপন বা ডায়ালাইসিস করতে হয়। এই চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। আমাদের দেশে ১০ ভাগ রোগীও এই চিকিৎসা পান না। সেই জন্য রোগ শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধের জন্য এই সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। এটিই কিন্তু উদ্দেশ্য। সিম্ফোজিয়াম, সেমিনার, র্যালি হবে। এর মাধ্যমে আমরা জনগণকে জানাতে চাই, আপনার কিডনি সম্পর্কে জানুন।
কী জানবেন? আপনার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে কি না, ডায়াবেটিস রয়েছে কি না। এই দুটো এখন প্রধান কারণ। এগুলো জানতে পারলে, শনাক্ত করতে পারলে সুবিধা হবে।
এনটিভি : কিডনি রোগ প্রতিরোধে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবহার কতখানি রয়েছে? স্ক্রিনিং বা প্রতিরোধে সংগঠন বা রাষ্ট্র বা মিডিয়ার কী করণীয়?
অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ : আসলে আমরা কিডনি রোগকে তিন ভাগে ভাগ করি। এক নম্বর ভাগটাই হলো প্রতিরোধ। কীভাবে এটি প্রতিরোধ করা যায়। আর দুই নম্বর হলো কিডনি রোগ যখন হয়ে গেল, তখন একে কীভাবে নির্মূল করতে পারি? আর তিন নম্বর হলো, যখন কিডনি শেষ পর্যায়ে, তখন কীভাবে তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়? উন্নয়নশীল বিশ্বে শেষ পর্যায় পর্যন্ত কিডনি চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই সেদিকে নজর না দিয়ে প্রতিরোধের দিকে খেয়াল রাখা উচিত।এই কাজটি কিন্তু সহজ। যদি আমরা জনসচেতনতা তৈরি করতে পারি এবং আমাদের সরকার কিছু উদ্যোগ নেয়, তাহলে আমরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কিডনি রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে ঠিক করতে পারি।
এটা কীভাবে করা যাবে? আজকের এই বিশ্বে ডায়াবেটিস হলো কিডনি রোগের প্রধান কারণ। দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো, উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন। আর তৃতীয় কারণ হলো, প্রদাহ জনিত কিডনি রোগ। একে আমরা নেফ্রাইটিস বা নেফ্রোটিক সিনড্রম বলি।
এখন ধরুন, বাংলাদেশের কথা। বাংলাদেশে প্রায় ১৬৫০টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে।কিডনি রোগের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ৮০ থেকে ৯০ ভাগ কিডনি অকার্যকর না হওয়া পর্যন্ত কোনো লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়া। এখন আমাদের ডায়াবেটিস হলো, এর কোনো লক্ষণ নেই। সুতরাং সে চিকিৎসকের কাছে আসে না। আর ৪০ থেকে ৫০ ভাগ ডায়াবেটিস কখনো নির্ণয়ই হয় না। আবার ৫০ ভাগ উচ্চ রক্তচাপের রোগী জানে না যে তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। সেই জন্য প্রধান যেটি দরকার ৪০ বছরের ওপরের মানুষদের স্ক্রিনিং করা। কমিউনিটি ক্লিনিক সরকারের রয়েছে। তবে এটি সক্রিয় কীভাবে করা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে কিন্তু চিকিৎসকেরও প্রয়োজন নেই। যেসব ৫০০/ ৬০০ রোগী আসবে, তাদের বয়স যদি ৩০ বা ৪০ বছরের ওপরে থাকে, তখন সে তার উচ্চতা নেবে, ওজন নেবে, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে কি না, সেটি লিপিবদ্ধ করবে। তার ইউরিন পরীক্ষা করে দেখবে, তার প্রস্রাবে অ্যালবুমিন যাচ্ছে কি না। আর দেখতে হবে ব্লাড পরীক্ষা করে, যেটি কেবল গ্লুকোমিটার দিয়ে করতে হয়, সেটি দিয়ে দেখবে তার ডায়াবেটিস রয়েছে কি না। যেহেতু সে চিকিৎসক না, তাই যেখানে এই বিষয়ে চিকিৎসক পাওয়া যায়, জেলা বা উপজেলা সেখানে ওই রোগীকে যেতে বলবে। তখন চিকিৎসক নির্দিষ্ট করবেন, তার ডায়াবেটিস রয়েছে কি না, তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে কি না, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন যায় কি না। দেখার সঙ্গে সঙ্গে মাত্র দুই তিনটি ওষুধ দিয়ে দিলে এই যে প্রতিরোধটা হয়ে গেল, এই যে রোগটা শনাক্ত হয়ে গেল, কিডনি রোগ কিন্তু সেখানেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এনটিভি : বাংলাদেশে কিডনি রোগ কোন পর্যায়ে রয়েছে? সাধারণত কোন কোন কিডনি রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়?
অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ : কিডনি রোগকে ৮০ ভাগ নীরব ঘাতক বলা হয়। আরেকটি বিষয় হলো, এটি খুব জটিল রোগ। রোগটির চিকিৎসা ব্যয়বহুল। শহরে যেই চিকিৎসা রয়েছে, গ্রামে সেই চিকিৎসা নেই। আমরা কিন্তু কিডনির যত্নের বিষয়টি সব জায়গায় পৌঁছে দিতে পারি না। সেই ক্ষেত্রে একদম খুব সহজ হলো, আপনি ব্লাড প্রেশার দেখলেন, ব্লাড সুগার দেখলেন, আর প্রস্রাবের সঙ্গে অ্যালবুমিন যায় কি না দেখলেন। এই তিনটি করলেই কিন্তু রোগটা নির্ণয় করা যায়।
আগে নেফ্রাইটিস ছিল প্রথম কিডনি রোগের কারণ। এখন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস। নেফ্রাইটিস রোগটি এখন আমরা ভালো করে দিতে পারি। আরেকটি বিষয় হলো একিউট রেনাল ফেইলিউর। এটাও কিন্তু একটা বেশ বাজে রোগ। দেখা যায়, বিশ্বে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ লোক এই সমস্যায় আক্রান্ত। এই রোগটি যদি থাকে এটি থেকে কিন্তু ক্রনিক কিডনি রোগের দিকে চলে যেতে পারে। সেটিও আমাদের জানতে হবে।
ডায়রিয়া, বমি থেকে আগে যেমন এই রোগটি হতো, এখন কিন্তু সেটি নয়। এখন যেটি হয়, ওষুধের মাধ্যমে হয়, সার্জারি বা অবসট্রাকটিভ কেয়ার থেকে হয়। এর দিকে আমাদের একটু নজর দিতে হবে। গর্ভাবস্থা সম্পর্কিত বা গর্ভপাত সম্পর্কিত। এগুলোর দিকে নজর দিলে আমরা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।
এনটিভি : এই যে অনেকগুলো রোগের কথা বললেন, রোগগুলোর চিকিৎসায় বাংলাদেশে কোন পর্যায়ে রয়েছে?
অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ : আসলে যদি বলি, আমাদের বিশেষজ্ঞদের কাছে কিডনি রোগ জটিল নয়। এটা খুব সহজ রোগ। এ রোগ নির্ণয় করা যায় আরো সহজে। শুধু সচেতন না হওয়াটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা।
এখন ধরুন, একজন ডায়াবেটিসের রোগী, তার রোগ নির্ণয় করাটাও খুব সহজ। আপনার খালি পেটে ব্লাড সুগার কত রয়েছ? খাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে ব্লাড সুগার কত রয়েছে? বলে দেওয়া রয়েছে ছয় দশমিক পাঁচের ওপরে খালি পেটে হলে, আর খাওয়ার পর যদি ব্লাড সুগার ১১ এর ওপরে থাকে আপনি ডায়াবেটিসের রোগী। এখন ডায়াবেটিস ধরার পরে কিন্তু আপনার কিডনির স্ক্রিনিং শুরু করতে হবে। কীভাবে শুরু করবেন? আপনার যে জীবনযাপনের ধরন রয়েছে, একে বদলাতে হবে। জীবন যাপনের ধরন পরিবর্তন করা সহজ। কিন্তু আমরা করি না। যেমন, আপনি যদি বেশি পরিমাণে ভাত খান বা মিষ্টি খান বা নিয়মিত খাবার না খান, তাহলে এটি ঠিক করতে হবে। কতটুকু ভাত খাবেন, কয়টি রুটি খাবেন, প্রোটিন কতটুকু যাবে, চর্বি কতটুকু যাবে, একে নিয়ন্ত্রণ করে নিতে হবে। আপনাকে প্রতিদিন হাঁটার অভ্যাসটা করতে হবে। এতে দেখবেন যে ব্লাড সুগারের মাত্রা দুই থেকে তিন এমনিতেই নেমে গেছে। এরপর যদি আপনি ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তাহলে ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে। জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করে এবং ট্যাবলেট খেয়েও যদি ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে আপনাকে ইনসুলিন নিতে হবে। এর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। এটি ধরে রাখা খুব কষ্টকর। কিন্তু ধরে রাখতে হবে।
সুস্থ কিডনির পূর্ব শর্ত হলো যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। একই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এই নিয়ম যদি আপনি মেনে চলেন আপনার প্রস্রাবে আর অ্যালবুমিন বের হবে না। কিডনির রোগও হবে না। আমরা জানি যে ডায়াবেটিস থেকে ৪০ ভাগ ক্রনিক কিডনি রোগ হয়। একবার যদি প্রস্রাবে অ্যালবুমিন যাওয়া শুরু করে তার উচ্চ রক্তচাপ হতে থাকে, তখন ডায়াবেটিসের সঙ্গে সঙ্গে অ্যালবুমিন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এরও ওষুধ রয়েছে এবং রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেটারও ওষুধ রয়েছে। এটা খুব সহজ ওষুধ। বাজারে এর দামও খুব বেশি নয়। তাহলে ডায়াবেটিস চলে গেল।
এখন হলো উচ্চ রক্তচাপ। আমরা জানি, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের ব্লাড প্রেশার থাকতে হবে ১৪০/ ৯০। এখন বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই আপনি যদি জীবন যাপনের ধরন পরিবর্তন করেন, তাহলে পাঁচ মিলিমিটার মার্কারি সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ দুটোই কমে যাবে- কেবল যদি আপনি ৩০ থেকে ৪০ মিনিট হাঁটেন- আপনি যদি লবণ কম খান। তাহলে কিন্তু এটাও চলে গেল। এরপরও যদি ১৪০/ ৯০ এর ওপরে থাকে আপনাকে ওষুধে চলে আসতে হবে। খুব সহজ ওষুধ। আপনার এত নামিদামি ওষুধেরও দরকার নেই। কেবল আপনাকে কী পদ্ধতিতে ওষুধ খেতে হবে, সেটি জানতে হবে। কেউ যদি শুরু থেকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খায়, তাকে বুঝতে হবে, সারা জীবন ওষুধ খেতে হবে। আমাদের দেশের রোগীরা করে কী, ওষুধ বন্ধ করে দেয়। বলে, ‘আমি তো ভালোই রয়েছি। বেশিদিন ওষুধ খেলে তো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবে।’ না এসব ওষুধের অতটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। ওষুধ আবিষ্কারেও এত পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়েছে যে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুব কম।
আর যদি নেফ্রাইটিস আসে, এটি হলো জটিল। কিন্তু ৩০ ভাগ নেফ্রাইটিস এমনি নির্মূল হয়ে যায়। বাকি ৩০ ভাগ ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আর বাকি ৩০ ভাগ নেফ্রাইটিস ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হয়ে ১০ থেকে ১৫ বছর পরে বা তার আগে ৯০ ভাগ কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে।
এই রোগীগুলো এবং যারা ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করছে না, সেই রোগীগুলো- যারা উচ্চ রক্তচাপের রোগে ভুগে ওষুধ খাচ্ছেন না, সেই রোগীগুলো- এই রোগীগুলোর একপর্যায়ে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হয়। এর বৃদ্ধিটা কমানো যায় না। আরো কিছু ওষুধ যোগ করতে হয়। তবে তাদের আরো পাঁচ থেকে ১০ বছর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায়। একপর্যায়ে ডায়ালাইসিস বা ট্রান্সপ্ল্যান্ট (কিডনি প্রতিস্থাপন)-এর মতো প্রক্রিয়ায় যেতে হয়।
আমি বাংলাদেশের কথা বলছি, দুই কোটি লোকের মধ্যে দশমিক দুই ভাগ, কিডনি ফেইলিউর হয়। তবে আমরা অসম্ভবভাবে মানুষকে ফোকাস করছি ডায়ালাইসিস, কিডনি ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের দিকে, যখন তার আর করার কিছু থাকে না। আমরা যদি প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরোধ, স্ক্রিনিং, দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিরোধের উন্নতি ধরে রাখতে পারতাম, সঠিক চিকিৎসা দিয়ে তাহলে কিন্তু মানুষের ভোগান্তি কমে যেত। টাকা পয়সা কম খরচ হতো। তাকে একেবারে শেষ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে হতো না।
এনটিভি : ডায়ালাইসিস ও কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের ধরন ও খরচ বাংলাদেশে কোন পর্যায়ে রয়েছে, সে বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ : বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় আদর্শ চিকিৎসা আমাদের দেশে হচ্ছে। ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা, ডায়ালাইসিস, ট্রান্সপ্ল্যান্ট সব আমাদের দেশে রয়েছে। কিন্তু আমি যেটি বলতে চাচ্ছি, আজকের জন্য, ডায়াবেটিস হোক, আমরা তো বলি পাঁচটি পর্যায়। আবার সিকেডি বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজেরও পাঁচটি পর্যায় রয়েছে। পর্যায় এক, দুই এর পরে পাঁচটা। যখন অল্প থাকে তখন পর্যায় এক, দুই, তিন,চার। যখন বেশি হয় তখন পর্যায় পাঁচ। সেই জায়গাটিতে আমরা যেতে দিতে চাই না।
আমার যদি ডায়াবেটিস হয়, যদি নাও চিকিৎসা হয় তাহলে ২৫ বছর লাগবে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে। তাই ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণ করি, উচ্চ রক্তচাপ যদি নিয়ন্ত্রণ করি, সিগারেট যদি না খাই, জীবন যাপনের ধরন যদি পরিবর্তন করি, যদি কাইক পরিশ্রম করি, মদ্যপান না করি, তাহলে এমনিতেই ভালো হয়ে যাব। আমার রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মানুবর্তী জীবনযাপন করতে হবে। আমার খাবারের অভ্যাস যদি পরিবর্তন করি তাহলেও ভালো হবে।
আপনারা কিন্তু জানেন, বিশ্বে ৬০-৭০ বছর বয়সের লোকদের কিডনি রোগের সংখ্যা বেশি। আমাদের দেশে কিন্তু গ্রামগঞ্জে এই সেবাটি যায়নি। বিশ্ব কিডনি দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য কিন্তু সেই জায়গাতেই। ‘প্রত্যেকের জন্য সব জায়গায়’। সেই দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। বেসরকারিভাবে কিছু সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে সরকারিভাবে এটি আসতে হবে। সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবাই মিলে এটি করতে হবে। সরকারি পলিসির মধ্যে এটি থাকতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে রোগ নির্ণয়টা করে দিতে হবে।
কিডনি রোগ বলতে অনেক কিছু বোঝায়। এটি প্রস্রাবে সংক্রমণ হতে পারে, নেফ্রাইটিস হতে পারে, উচ্চ রক্তচাপের কারণে হতে পারে। জন্মগত পলিসিসটিক কিডনি ডিজিজ হতে পারে। একিউট কিডনি ডিজিজ হতে পারে। তাৎক্ষণিক কিডনি যে অকেজো হয়, সেটি কিন্তু চিকিৎসা দিলে ৯০/৯৫ ভাগ ভালো করে দিতে পারি। তবে কথা হলো ঠিক সময় ঠিক চিকিৎসাটা দিতে হবে।
কিন্তু সিকেডি হলো ধীর গতিতে যায়,এখানে কিন্তু বৃদ্ধিটা থামাতে না পারলেও ধীর করতে পারি। আর যদি প্রতিরোধ করতে পারি, তাহলে তো খুব ভালো কথা। সেই দিকে জোর দিতে হবে। সেই জোরটা আমাদের সম্মিলিতভাবে দিতে হবে।
এনটিভি : কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানের করতে গেলে কী করা উচিত?
অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ : আমরা এখন সীমিত পরিমাণে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করি। আর সেটি হলো জীবিত অবস্থায়। আমাদের যে ২০১৮ সালে অরগান অ্যাক্ট আইনটি পাস হয়েছে, এতে দাতার পরিধি অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন : বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা, মামা, ফুফু, খালা, চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, খালাতো ভাই, নানা, নানি, দাদা, দাদি – যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬৫ এর মধ্যে, যাদের ডায়াবেটিস নেই, উচ্চ রক্তচাপ নেই, যার দুটো কিডনি সম্পূর্ণভাবে কার্যক্ষম, তারা ইচ্ছে করলে তার আত্মীয়কে কিডনি দিতে পারবেন। এই ধরনের কিডনি সংযোজন করা হয়, বিশ্বে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ভাগ।
কিন্তু ৭০ থেকে ৮০ ভাগ উন্নত বিশ্বে, কিডনি পাওয়া যায় মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে। এখানে আমরা মৃত ব্যক্তি বলতে, বাসায় মারা গেল, হাসপাতালে মারা গেল বা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল, সেটি বোঝাই না। এই মৃত্যুটা হতে হবে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। যাকে আমরা বলি, ক্লিনিক্যালই ডেড। তবে তার অঙ্গটি এখনো মরে যায়নি। অর্থাৎ ভ্যান্টিলেশনের সাহায্যে তার ফুসফুস, তার রক্ত পরিসঞ্চালন, হার্ট ঠিক রাখা হয়েছে। এই অবস্থায় যদি কেউ মারা যায় এবং ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের চিকিৎসক শত চেষ্টা করে রোগীকে বাঁচাতে না পারে, তখন মেডিসিনের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, নিউরোমেডিসিনের বিশেষজ্ঞ, বোর্ড বসে, ওই বোর্ড ও পরিবার যদি তাকে ভ্যান্টিলেশন খুলে দেওয়ার অনুমতি দেয়, তখন ওই কিডনিটা ব্যবহার করা যাবে।
এনটিভি : কিডনি সুস্থ রাখতে আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ : চল্লিশ বছরের ওপরে হলেই আপনাকে লবণটা বাদ দিতে হবে। চিনি, মিষ্টি এগুলো পরিহার করতে হবে। প্রতিদিন আপনাকে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট হাঁটতে হবে। আপনার যদি ওজন বেড়ে যায়, ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর আপনি খেয়াল করবেন আপনার শিশুরাও যেন ফাস্টফুড না খায়। তারা যেন সবসময় সহজ খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা যেন ওজনাধিক্য না হয়, তারা যেন খেলাধুলার জন্য কিছু সময় পায়। তারা যেন সবসময় টেলিভিশন না দেখে এবং কম্পিউটার যেন বেশি নাড়াচাড়া না করে।
এনটিভি : কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষা সব জায়গায় পৌঁছে দিতে আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ : বেসরকারিভাবে, সরকারিভাবে কাজ করতে হবে। জনগণকে বার্তা দিতে হবে, আপনার কিডনিটা আপনি দেখে নিন। দেখে নিন মানে কী? ব্লাড প্রেশার আপনি গ্রামে দেখতে পারেন, প্রস্রাবের পরীক্ষাটা আপনি গ্রামে করতে পারেন, ব্লাড সুগার করতে পারেন। এই তিনটি করলেই তো হয়ে গেল। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখেন, ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখেন, কায়িক পরিশ্রম করেন, ওজন কমান, লিপিড প্রোফাইল কমান, ভালো সুস্থ খাবার খান, মদ্যপান এড়িয়ে চলুন।