হাত বা পায়ে আঘাতের চিকিৎসা কী
বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আমরা আঘাত পাই। সময় মতো সঠিক চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চিকিৎসা না নিলে অঙ্গহানীর মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. মহিউদ্দিন। তিনি নিটরের হ্যান্ড অ্যান্ড মাইক্রোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩১৫তম পর্বে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়।
urgentPhoto
প্রশ্ন : আঘাত জনিত সমস্যা অত্যন্ত ব্যাপক একটি বিষয়। মাথায় আঘাত থেকে শুরু করে শরীরের যেকোনো অংশে আঘাত লাগতে পারে। এতে অনেক সময় মৃত্যুও ঘটে। সাধারণত কী কী আঘাতের সমস্যা নিয়ে রোগীরা আপনাদের কাছে আসে?
উত্তর : আঘাত জনিত সমস্যা নিয়ে রোগীরা আমাদের কাছে আসে। এর সংখ্যা খুবই বেশি। বর্তমানে নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতালের ওপর প্রচুর চাপ রয়েছে এসব রোগীর। বেশির ভাগ রোগীই আসে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন পারিবারিক কলহ, মারামারি, ডাকাতি, কোপজনিত কারণেও আঘাত পেয়ে রোগীরা আসে। এর মধ্যে প্রধানত মাথায় আঘাতজনিত কারণে সমস্যা হতে পারে। মুখমণ্ডলে আঘাত হতে পারে। বুকে আঘাত পেতে পারে। হাতে পায়ে তো আঘাতের সমস্যা নিয়ে আসেই। সাথে কোটির হাড় ভাঙ্গা, পিঠের বা মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙ্গা, পাশাপাশ মেরুদণ্ডের স্পাইনাল কর্ডে আঘাত নিয়ে আসে। এমনকি দুই পা সামান্য প্যারালাইসিস থেকে পুরো প্যারালাইসিস নিয়ে আমাদের কাছে আসে।
প্রশ্ন : অর্থপেডিক সার্জন হিসেবে এই আঘাতজনিত সমস্যাগুলো আপনারা মোবাবিলা করেন কীভাবে? চিকিৎসার জন্য আপনারা কী করে থাকেন?
উত্তর : যখনই একজন রোগী আসে আমরা চেষ্টা করি তার জীবন বাঁচানোর জন্য। যেহেতু আঘাতজনিত কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে, আমরা যেকোনো ফ্রাকচারকে দুইভাগে ভাগ করি। ওপেন ফ্রাকচার ও ক্লোজ ফ্রাকচার। ওপেন ফ্রাকচার মানে যেখানে রক্ত বাইরে চলে আসছে। বাইরে কারো রক্তপাত না হলেও রোগী জটিল রক্তশূন্যতা নিয়ে আসতে পারে। ভেতরে হাড় ভেঙ্গে গেলে এমন হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাকে স্যালাইন দেই, রক্ত দেই। জীবন বাঁচানোর জিনিসগুলো করার পর আমরা এক্স-রেতে যাই। এক্স-রে করার পর আমরা নির্ণয় করি কী ধরনের আহত সে হয়েছে। এরপর আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেই। প্রয়োজন হলে সিটি স্ক্যান, এমআরআই এগুলোও আমরা করি।
প্রশ্ন : হাত-পা ভেঙ্গে গেলে আপনারা কী করেন?
উত্তর : ভাঙ্গাটা আমরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ করতে পারি। যদি দেখা যায় ফ্রাকচার আছে তবে হাড় সরে যায়নি, তখন আমরা একই অবস্থায় রেখে প্লাস্টার করে দেই। প্লাস্টার করার সময় বিভিন্নভাবে খেয়াল রাখতে হবে প্লাস্টার ঠিক চাপে করা হচ্ছে কি না, হাত বা পায়ের অবস্থা ঠিক হচ্ছে কি না। অনেক সময় দেখা যায়, খুবই সাধারণ ফ্রাকচার ছিল, সেখানে বড় কোনো ঝুঁকি ছিল না। তবে ভুল প্লাস্টারের কারণে, হাত পায়ের অবস্থা ঠিক না হওয়ার কারণে ওই অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এমন হয়ে অংশটি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ওই রকম অবস্থায় আমরা হাত-পা কেটে ফেলতে বাধ্য হতে পারি। এই জন্য প্লাস্টার সঠিকভাবে দেওয়া খুব জরুরি। আমরা যদি দেখি হাড় ভাঙ্গার পর সরে গেছে বা বেশি সরে গেছে তখন চেষ্টা করি সেখানে এনেসথেসিয়া দিয়ে বা সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে ওটাকে বসানোর। বসানোর সময় আমাদের সিয়াম মেশিন আছে সেটি দিয়েও আমরা বুঝতে পারি অবস্থাটা ঠিক আছে কি না।
মেশিনটা সি সেপ তাই একে সিয়াম মেশিন বলা হয়। এটি দিয়ে দেখে আমরা সঠিকভাবে প্লাস্টার করে দিতে পারি। তবে এর থেকে যদি আরো খারাপ হয়, যদি হাড়টা ভেঙ্গে বাইরে চলে আসে। তখন ওখানে একটি ক্ষত তৈরি হয়। সে অবস্থায় এটি জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হয়ে যায়। তখন এ অবস্থায় প্লাস্টার দিয়ে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। তখন এ অবস্থায় তাকে আমরা ওটিতে নিয়ে প্রথমে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্যালাইন দিয়ে আমরা ধুয়ে দেই। পাশাপাশি যে মৃত টিস্যুগুলো রয়েছে সেগুলো পরিষ্কার করে আমরা ছেঁটে ফেলি। যখন আমরা দেখি ক্ষতটি ঝকঝকে হলো, তখন আমরা জীবাণুমুক্ত ড্রেসিং দেই। এরপর আবার অবস্থা অনুযায়ী প্লাস্টার করে রাখি। একই রোগীকে আমরা ২৪ ঘণ্টা অথবা ৪৮ ঘণ্টা পর সার্জারি করি। আর আমরা দেখি আমাদের ত্বক দিয়ে মাংশপেশি দিয়ে হাড়কে যদি ঢাকা সম্ভব হয়, তখন ক্রস করি। আর যদি ঢাকা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্য জায়গা থেকে আমরা মাংস পেশি অথবা চামড়াসহ ঘুরিয়ে নিয়ে এসে সেখানে ঢেকে দেই। এরপর অন্যান্য কাজগুলো করতে পারি।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন, ক্লোস রিডাকশনে অর্থাৎ অস্ত্রোপচার না করে ভাঙ্গা দুটো অংশকে কাছাকাছি এনে সেটাকে আপনারা প্লাস্টার করেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক নন মেডিকেল পারসন অর্থাৎ যারা পাস করা চিকিৎসক নয়, হাতুড়ে ডাক্তার বা গ্রামের চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত এ রকম লোকেরা হাতকে লতাপাতা দিয়ে কিংবা বাঁশ দিয়ে বাঁধে। এটির ঝুঁকি কতখানি হতে পারে?
উত্তর : এর প্রচণ্ড ঝুঁকি আছে। কারণ তারাও এ ধরনের চিকিৎসা পাচ্ছে, বেশির ভাগ ফ্রাকচারের পর খুব একটি ডিসপ্লেসমেন্ট থাকে না। দুই একটা রোগী তাদের কাছে যায়, তাদের প্লাস্টার দেওয়ার পর ভালো হয়ে যায়। তখন সাধারণ মানুষ মনে করে সে বিশাল একজন চিকিৎসক, তার কাছে যেতে থাকে।
তবে হাড়ের ধর্ম হলো কাছাকাছি আনলে এটি জোড়া লেগে যাবে। আমাদের কাজ একে সোজা করে জায়গামতো বসিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই সোজা করে এবং জায়গামতো বসাতে গিয়ে যদি প্লাস্টারের চাপ এবং অবস্থা ঠিক না হয়, আমি যদি কম চাপ দেই ঢিলা হয়ে যাবে। বেশি চাপ দিলে ওই অংশের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে, অংশটি মরে যেতে পারে, পঁচে যেতে পারে। তখন হাত পা বা কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বেশিরভাগ সময় কেটে ফেলতে হয়, অনেক সময় আগে এলে হয়তো রক্ষা করা যায়। তবে যেখানে দেখা যাচ্ছে সাধারণ সহজ একটি প্লাস্টারে সব হয়ে যেত এই সামান্য ভুলের জন্য এত বড় একটি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এর জন্য অনেক সময় অঙ্গহানী পর্যন্ত হতে পারে।