ডায়াবেটিস থাকলে কি সারাজীবন ইনসুলিন ব্যবহার করতে হয়?

ডায়াবেটিস বেশ প্রচলিত একটি রোগ এখনকার সময়ে। ১৩ জানুয়ারি এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৬৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিম উদ্দিন। বর্তমানে তিনি ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও বারডেমের মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : একজন মানুষকে আমরা কখন ডায়াবেটিক রোগী বলব?
উত্তর: আসলে আমরা সবাই জানি, ডায়াবেটিস বহুমূত্র রোগ। ডায়াবেটিস তখনই হবে যখন রক্তে শর্করা বাড়বে। রোগী তো আর এসে বলবে না আমার রক্তে শর্করা বেড়েছে। ডায়াবেটিস চার ধরনের : টাইপ ওয়ান, টাইপ টু, জেসটেশনাল ডায়াবেটিস, আরেকটি ডায়াবেটিস হয় যার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের কারণ পাওয়া যায় না। আর ডায়াবেটিস টাইপ টু-এর পরিমাণ বেশি। ৯৮ থেকে ৯৯ ভাগ রোগীর ডায়াবেটিস টাইপ টু। টাইপ ওয়ান খুব কম হয়।
টাইপ টু মানে বেশি বয়স্ক লোকের ডায়াবেটিস। এটি দুইভাবে হতে পারে। একটি হলো রোগীরা লক্ষণ নিয়ে আসতে পারে। উপসর্গ অনেক বেশি নিয়ে আসতে পারে। আর আরেকটি হলো, রোগী হয়তো জানে না তার সমস্যা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাধারণত অন্য কারণে রক্ত পরীক্ষা করলে রোগ ধরা পড়ে। বিশেষ করে নিয়মিত পরীক্ষা অথবা বিদেশে যাওয়ার জন্য তার পরীক্ষা, অথবা অন্য রোগের জন্য পরীক্ষা করলে তখন ধরা পড়ে তার রক্তে শর্করার সমস্যা।
এখন শর্করার একটি মাত্রা রয়েছে। মাত্রার আগে আমরা উপসর্গের কথা বলি। রোগীর রক্তে শর্করা যদি বেশি থাকে, তাহলে বিশেষ কতগুলো উপসর্গ দেখা দেবে। আমরা যারা চিকিৎসা করি, তারা দেখি, বেশির ভাগ রোগীই আসে ওজন কমে গেছে এই অভিযোগ নিয়ে। ওজন কমার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে ডায়াবেটিস বেশি হলে দ্রুত ওজন কমে যেতে পারে। যখনই কারো ওজন কমে যায় পরীক্ষা করলে দেখা যায়, ডায়াবেটিস হতে পারে।
যেমন : একজনের খুব ক্ষুধা লাগে, খুব পিপাসা লাগে, সে হয়তো খায় কিন্তু তার ওজন বাড়ে না। রাতে ঘুম ভেঙে উঠে পানি খেতে হয়। প্রস্রাব বেশি হয়। এগুলো হলো উপসর্গ।
প্রশ্ন : এই রোগটি এত প্রাধান্য পায় কেন?
উত্তর : ডায়াবেটিস হলো সারা শরীরের রোগ। একটি অসুখে সব অঙ্গ-প্রতঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আপনি যদি নিয়ন্ত্রণে রাখেন স্বাভাবিক মানুষের মতো থাকবেন। নিয়ন্ত্রণে না রাখলে সমস্যা হবে। কারো চোখ নষ্ট হয়ে অন্ধ হয়ে যাবে, কারো হার্টের অসুখ হবে। কারো কিডনির অসুখ হবে। সেই জন্য প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিদিনের জন্য এই রোগ সমস্যা করে। এমন নয় যে ওষুধ খেলাম আর সেরে গেল। এমন নয় নিউমোনিয়া হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক খেলে সেরে গেল। এটি জীবনব্যাপী অসুখ। এজন্য প্রতিটি মানুষকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানতে হবে এবং সচেতন হতে হবে।
আমরা যেটা বলছিলাম কীভাবে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে? সকালের নাস্তার আগে যদি রক্তের পরীক্ষা করি, তাহলে যদি ৬ মিলি মোল পার লিটারের বেশি থাকে, সেটি ডায়াবেটিস। একইভাবে যদি খাওয়ার পরে করি, সেক্ষেত্রে যদি ৮ মিলি মোলের বেশি হয়, সেটি হলো ডায়াবেটিস। আরেকটি পরীক্ষা রয়েছে, যেটি তিন মাসের গড় শর্করা বলে, সেটি হলো হিমোগ্লোবিন এওয়ানসি। সেটি যদি ৬.৫ এর বেশি থাকে, সেটিও ডায়াবেটিস।
স্বাভাবিক যদি একজনের ৭ বা তার বেশি হয় তখন ডায়াবেটিস হয়। এখন ৬ থেকে ৬.৯ হলে সেটি অস্বাভাবিক। আবার খাওয়ার পরও এইরকম ৭.৮ পর্যন্ত মোটামুটি ঠিক। ৭.৮ এর পরে ১১.১ পর্যন্ত হলে তবে এটি ডায়াবেটিস নয়। অর্থাৎ তাদের রক্তের শর্করার মাত্রা অস্বাভাবিক আছে, তবে ডায়াবেটিস নয়। এদের আলাদা করার বিষয় আসে কেন? কারণ, এসব লোকের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা অন্য লোকের চেয়ে তিনগুণ বেশি।
আর ডায়াবেটিস রোগের জটিলতা, বিশেষ করে বড় রক্তনালির রোগ, হৃদরোগ- এগুলো ইমপেড গ্লুকোজ টলারেন্স রেটের মতো একই রকম। সেজন্য এদের নিয়মকানুন খাওয়া-দাওয়া সব ডায়াবেটিস রোগীর মতো পালন করা উচিত।
প্রশ্ন : আরেকটি বিষয় যেটি আমরা শুনি, বাবারও ডায়াবেটিস ছিল, আমারও হবে। এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
উত্তর : পরিবারের কারো ডায়াবেটিস থাকলে ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা থাকে। বাবা-মায়ের থাকলে হতে পারে। তবে হবেই এমন কোনো কথা নেই। টাইপ ওয়ান এবং টাইপ টু বললাম। টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে কিন্তু জিনগত কারণ নেই। অটোইমিউন রোগ বা ভাইরাল ফিবার এগুলোতে হতে পারে। টাইপ টুতে বংশের একটি প্রভাব রয়েছে। এখন আপনি সেটি ২৫ ভাগ ধরতে পারেন। তবে টাইপ টু শুধু বংশের প্রভাব নয়। এর জন্য আবার পরিবেশগত প্রভাবও রয়েছে।
আমাদের দেশে আগে এত ডায়াবেটিক রোগী ছিল না। এখন ১০ ভাগ লোকের ডায়াবেটিস আছে। মানে এক কোটি ৬০ লাখ লোকের ডায়াবেটিস রয়েছে। এ রকম কিন্তু আগে ছিল না। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখনো ছিল না। এর জন্য নিশ্চয়ই একটি পরিবেশগত কারণ রয়েছে। একে বলে মাল্টি ফ্যাক্টর। জিনগত, পাশাপাশি পরিবেশগত কারণ রয়েছে। এটি টাইপ টু ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
প্রশ্ন : একজন রোগী যখন ডায়াবেটিক, তখন তার জীবনযাত্রা পরিবর্তনের কিছু বিষয় চলে আসে। সেই বিষয়গুলো যদি আপনি বলতেন?
উত্তর : প্রথম কথা বলি, ডায়াবেটিস হওয়া মানে পঁচে যাওয়া নয়। ডায়াবেটিস হওয়া মানে আমার সব কাজ নষ্ট হয়ে গেল, সেটি নয়। একজন ডায়াবেটিস রোগী সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে, যদি তার রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে। মানুষ তো আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, সে যদি মস্তিষ্ক খাটায় ভালো থাকতেই পারে। ভালো না থাকার কোনো কারণ নাই। কোনো যুক্তি নেই।
এখন মূল তিনটি জিনিস আমাদের জানতেই হবে। একটি হলো জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করতে হবে। দুই নম্বর হলো, ওষুধ। তিন নম্বর হলো, শিক্ষা।
এখন আপনার প্রতিদিনের অসুখ, প্রতি সপ্তাহের অসুখ, দৈনিক চিকিৎসকের কাছে যাবেন না কি? তাই প্রতিটি লোককে ডায়াবেটিস সম্বন্ধে জানতে হবে। আমাদের সৌভাগ্য ডায়াবেটিসের জন্য আমাদের দেশে অধ্যাপক ইব্রাহিম ছিলেন। ডায়াবেটিস নিয়ে আমাদের দেশে অনেক কিছু করে গেছেন তিনি। ওনার একটি গাইড বই আছে, সেটি সারা পৃথিবীতে অনন্য। এই গাইড বই যদি কোনো ডায়াবেটিস রোগীর কাছে থাকে এবং সে যদি পড়ে, তার চিকিৎসকের কাছে খুব কম যেতে হবে। তাই শিক্ষাটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
আর আমরা যেটা বলি, জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন দুইভাবে হয়। একটি হলো আপনি খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করবেন। খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ মানে খেতে পারবেন না, সেটি কিন্তু নয়। আপনি সব কিছু খেতে পারবেন। তবে হিসাব করে। সব খাবারই খাবেন, তবে পরিমিত। এতে কিন্তু নিষেধ নেই। এখন আপনি এমন খাবার খেলেন যাতে ওজন দিন দিন বেড়ে গেল, সেটি তো হবে না। আবার এমন খাবার খেলেন এতে আপনার কোলেস্টেরল বেড়ে গেল, সেটিও হবে না। আবার এমন খাবার খেলেন রক্তচাপ বেড়ে গেল, সেটিও হবে না। তাই আপনার খাবার হিসাব করে খেতে হবে। এটি হলো জীবন যাপনের পরিবর্তন। আরেকটি হলো, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়াম মানে দৌঁড়াতে হবে, সেটি নয়। বা দৈনিক সাঁতার কাটতে হবে, সেটিও নয়। এমন ভাবে করবেন, ৪৫ মিনিট যেন হাঁটার সময় পান। প্রতিদিন না পারলে সপ্তাহে পাঁচ দিন যদি আধা ঘণ্টা করেও করেন, তাহলে লাভ হবে।
প্রশ্ন : ব্যায়ামের বিষয়টি কী ব্যক্তি বিশেষে আলাদা হবে?
উত্তর : ব্যায়াম মানে কী? ক্যালোরি ঝড়ানো। ব্যায়াম করলে ইনসুলিনের কাজ বাড়ে। ব্যায়াম করলে শর্করার ব্যবহার বেশি হয়। শরীরের চর্বি পোড়ে বেশি, কাজে লাগে।
প্রতিটি লোকের প্রতিদিন ৪৫ মিনিট এমনভাবে হাঁটা উচিত, যেন গা ঘামে, ক্ষুধা লেগে যায়, স্পন্দন হয়। এখন একজনের পা ভেঙে গেছে আমি বললাম, ‘তুমি হাঁট’। তাহলে তো হবে না। একজনের আরথ্রাইটিস হয়েছে, বললাম, ‘তুমি হাঁট’। সেটিও তো হবে না। তাই একেকজনের একেক রকম হতে পারে।
প্রশ্ন : ইনসুলিন কী দীর্ঘদিন দিয়ে যেতে হয়?
উত্তর : অনেকে মনে করেন ডায়াবেটিস থাকলে সারা জীবনই ইনসুলিন নিতে হবে। ইনসুলিন কী হিরোইন নাকি? এখানে নেশার কোনো বিষয়ই নেই। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চলে এলে ইনসুলিন বাদ দিয়ে দেবেন। ইনসুলিনের একটি নিদের্শনা রয়েছে। এখন হয়তো আপনার শর্করা ২৭ মিলি মোল। আপনি কী ইনসুলিন ছাড়া চিকিৎসা নিতে পারবেন। এখন ধরেন ডায়াবেটিসের জটিলতা নিয়ে আসছেন, তখন তো অন্য ট্যাবলেট দেওয়া যাবে না। তখন ইনসুলিন দেবেন। আবার গর্ভবতী নারী, ইনসুলিন ছাড়া কিছু দেওয়া যাবে না। এ রকম কিছু নির্দিষ্ট বিষয় রয়েছে যেখানে ইনসুলিন লাগে। এ ছাড়া আছে, যেমন ধরেন, ১০ বছর ধরে কারো ডায়াবেটিস রয়েছে। ট্যাবলেটে তার কাজ হচ্ছে না, তখন কী করবেন? ইনসুলিন দিতে হবে। তবে বৈজ্ঞানিক কিছু কারণ রয়েছে, যেমন : একজনের ধরেন এওয়ানসি ৯ এর বেশি হয়, তার ট্যাবলেটে হয় না। যখন ৯-এর বেশি হয় তখন ইনসুলিন লাগবে।