তুলসী কথা
গ্রামের মানুষ সর্দি, কাশি বা ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা হলে প্রথমেই যে গাছটির শরণাপন্ন হয় তার নাম অবশ্যই তুলসী। তবে এ তালিকায় বাসকও আছে। শুধু গ্রামই নয়, শহরের মানুষও আজকাল গাছ দুটির যথার্থ ব্যবহার করছে। তুলসী শুধু যে ওষুধিগুণের জন্য বিখ্যাত তা নয়, গাছটিকে অনেকে পূজাও করে থাকে। ধর্মীয় রীতি, ব্যবহারিক গুণ, সর্বোপরী নান্দনিক বৈশিষ্ট্য এ গাছকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত করেছে।
হিন্দু ধর্মমতে তুলসীগাছ অতি পূজনীয়। এ কারণে প্রত্যেক হিন্দু বাড়িতেই দু-একটি তুলসী গাছ থাকা আবশ্যকীয়। বিশেষ করে সান্ধ্য পূজায় তুলসী অনিবার্য। এই গাছ কেন এমন পবিত্র, ধর্মশাস্ত্রে সে সম্পর্কে কয়েকটি মতামত রয়েছে। ব্রহ্মপুরাণ মতে- আগে ইনি (তুলসী) রাধিকার সখি ছিলেন। কিন্তু কোনো এক সময় রাধার অভিশাপে তিনি ধর্মধ্বজ রাজার কন্যা হিসেবে মাধবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন এবং তখন থেকেই তুলসী নামে অভিহিত হন। পরে আবার তিনি শঙ্খচূড় নামক দৈত্যের পত্নী হন। শঙ্খচূড় কৃষ্ণ কর্তৃক নিহত হলে তিনি সহমৃত্যুবরণ করেন। তারপর পুনরায় কৃষ্ণের আশীর্বাদে তাঁর কেশে তুলসী বৃক্ষের জন্ম হয়। হিন্দু ধর্মে এভাবইে তুলসী গাছকে একটি মর্যাদাপূর্ন আসনে পাওয়া যায়। এটা মূলত তুলসী গাছের একটিমাত্র দিক। তা ছাড়া তুলসী ব্যবহারে যে সব রোগের উপশম হয় তার তালিকাও অনেক দীর্ঘ।
প্রধানত এ দুই কারণে তুলসী আমাদের ঘরে ঘরে ব্যাপক আদৃত। টবে চাষযোগ্য হওয়ায় আমাদের সকল পার্ক বা উদ্যান থেকে শুরু করে বারান্দা এবং ছাদবাগানেও এই গাছ প্রায়ই দেখা যায়। বিশেষত নানামুখী উপযোগিতা এবং ধর্মীয় সম্পৃক্ততার কারণে সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই গাছ আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় নিজেকে একাত্ম করেছে। একই কারণে গাছটি বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে আমাদের চারপাশে। আমাদের দেশে কয়েক ধরনের তুলসী (Ocimum spp.) দেখা যায়; বাবুই তুলসী, রামতুলসী, বন তুলসী, কর্পূর তুলসী ইত্যাদি। হিন্দি, সংস্কৃত ও তামিল ভাষায় এই গাছ তুলসী এবং আরবিতে উলসী বদরুজ নামে পরিচিত।
গুল্ম শ্রেণীর এই গাছ সর্বোচ্চ এক মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। কাণ্ড শক্ত ও চতুষ্কোণাকার। পাতার কিনারা খাঁজকাটা। তবে প্রজাতিভেদে এর তারতম্যও হতে পারে। কোনো কোনো গাছে প্রায় সারা বছরই ফুল ও ফল পাওয়া যায়। মঞ্জরি বড় ও অনিয়ত। ফুল প্রতি পর্বে আবর্ত আকারে সুসজ্জিত। ফুল ও ফলের মৌসুম শীতকাল। প্রাকৃতিক নিয়মে বীজ থেকেই সাধারণত বংশবৃদ্ধি হয়। গাছটি আগাগোড়াই ওষুধিগুণে ভরা। প্রধানত সর্দি-কাশির পারিবারিক ওষুধ হিসেবে আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। সর্দি-কাশিতে পরিমাণ মতো এই পাতার রস, আদার রস ও মধু মিশিয়ে খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া গাছটি কৃমিনাশক, বায়ুনাশক, হজমকারক ও রুচিবর্ধক হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। চর্মরোগে তুলসী পাতা দূর্বা ঘাসের ডগার সঙ্গে বেটে মাখলে ভালো হয়ে যায়। অজীর্ণজনিত পেটের ব্যথায় তুলসী পাতার রস বেশ উপকারী। ইউনানী চিকিৎসাশাস্ত্র মতে একতোলা গোল মরিচের সঙ্গে দুই তোলা কাঁচা তুলসীপাতা বেটে মোটর দানার পরিমাণ বড়ি তৈরি করা যায়। এ বড়ি ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় কুইনিনের মতো ফলদায়ক। সম্প্রতি ভারতের একদল আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, তুলসী গাছ সোয়াইন ফ্লুর প্রতিষেধক হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম।